দেবব্রত চৌধুরী লিটন

০১ মে, ২০১৬ ০০:০৯

মানুষ বিক্রির দলিল!

দলিল, তাও মানুষ বিক্রির! প্রথম শুনলে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন। তবে সিলেটের রেজিস্টারি অফিসের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে এরকমই একটি দলিল। নগরীর ভাষা সৈনিক মতিন উদ্দিন আহমদ যাদুঘরেও সংরক্ষিত আছে আরেকটি মানুষ বিক্রির দলিল।

দলিল সাধারণত সম্পত্তি বিনিময়ের ক্ষেত্রেই করা হয়ে থাকে। তবে এই দলিলগুলো যে সময়ের তখন কিছু মানুষও যে ছিলো অন্যের সম্পত্তি। তাদের পরিচয় ছিলো ক্রীতদাস।

মতিন উদ্দিন যাদুঘরের পরিচালক ড. মোস্তফা শাহ জামান চৌধুরী বলেন, শিল্প যুগের আগে তো মানুষ কেনাবেচা হতো। দরিদ্র-নিঃস্ব মানুষেরা স্থানীয় জমিদার-ভূস্বামীদের কাছে নিজেদের সন্তানদের বিক্রি করে দিতেন। এক ভূস্বামী আরেক ভূ-স্বামীর কাছেও ক্রীতদাসদের বিক্রি করতেন। এসব কেনাবেচা হতো দলিল করে। অনেকক্ষেত্রে দলিল ছাড়াও ক্রীতদাস কেনাবেচা হতো।

সিলেট রেজিস্টারি অফিসে রাখা দলিলটি ১২০৮ বঙ্গাব্দের (১৮০১ খ্রিস্টাব্দ) ২২ আশ্বিন তারিখে তৈরি করা হয়।

এতে উল্লেখ রয়েছে, শ্রীহট্ট (সিলেটের পূর্ব নাম) জেলার ভবানী নারায়ণ পালক ৪০ কপাইয়া (কড়ি) মূল্যে নরুদাসি (৩৫) ও তার মেয়ে অপ্সরা দাসী (৯) কে সদাবাস বর্মণ- এর নিকট বিক্রয় করে দলিলমূলে হস্তান্তর করেন।

এ দলিলের মাধ্যমে নিজের এবং উত্তরাধিকারীদের সমুদয় স্বত্ব ত্যাগ করে বিক্রেতা ভবানী নারায়ণ নরুদাসি ও তার মেয়েকে ক্রেতা সদাবাস বর্মণের নিকট বিক্রয় ও হস্তান্তর করেন।

এ বিক্রয় দলিলটির রেজিস্টারি অফিসার হিসেবে তৎকালীন জেলা জজ রেজিস্ট্রি করেছিলেন। ভবিষ্যৎ কোন জটিলতায় আইনের সহায়তা প্রাপ্তিই দলিল রেজিস্ট্রেশনের উদ্দেশ্য বলেও লেখা রয়েছে দলিলে।

সিলেট রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্টার আবু তালেব মিয়া সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্যান্য দলিলে সাথে এই দলিলটিও রেজিস্টারি অফিসের সংগ্রহশালায় রয়েছে। তবে এটি তেমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এই দলিলটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাই ভালোভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন ছিলো।


অপরদিকে, মতিন উদ্দিন যাদুঘরের সংগ্রহশালায় সংগৃহিত মানুষ বিক্রির দলিলটি ১২৪২ বঙ্গাব্দের। এই দলিলটি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে সংগৃহিত বলে জানান যাদুঘরটির পরিচালক ড. মোস্তফা শাহ জামান চৌধুরী। তবে অনেক পুরনো হওয়ায় এই দলিলের লেখা অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, সেসময় দলিলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কৃত ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হতো।

ইতিহাসবিদদের মতে, দাস প্রথার উদ্ভব ঘটে প্রাচীন গ্রীকে। দাসদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে গ্রিক সভ্যতা। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির বৈশ্বিক কোনো তারিখ নেই। একেক দেশে একেক সময়ে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়। প্রাচীন দক্ষিণ এশীয় পণ্ডিত কৌটিল্য দাসপ্রথা তুলে দিতে তৎকালীন সম্রাটকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ধারণা করা হয় এটিই দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রথম উদ্যোগ। সর্বশেষ ১৯৬৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।

দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও এখন অনেকক্ষেত্রে দাসপ্রথা চালু রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি  মাখন লাল কর্মকার। বিশেষত চা শ্রমিকরা এখনো ক্রীতদাসের মতো রয়ে গেছে বলে মত তাঁর।

মাখন লাল কর্মকার বলেন, চা শ্রমিকরা এখনো ক্রীতদাসের জীবন যাপন করে। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করলেও ভূমিসহ কিছুতেই তাদের অধিকার নেই। বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিকই রয়ে গেছে তারা। মালিকপক্ষও তাদের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত