আজমিনা আফরিন তোড়া

০১ জুন, ২০১৬ ০১:০৫

রক্ত

দিনটা ছিল আমার ১৭ তম জন্মদিন। প্রথম বারের মত স্বেচ্ছা রক্ত দান। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। তখন  সবে মাত্র এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। হাতে অঢেল সময়। গোল্লায় যাওয়া কিংবা মানুষ হবার জন্য যথেষ্ট অবসর বটে! মানুষ হতে হয় একা, নিজে নিজে, বিবেকের তাড়নায় নিজের তাগিদ থেকে। গোল্লায় যাবার জন্য তেমন কিছু না, দুই চার জন সেই মাপের বন্ধু বান্ধব জুটলেই যথেষ্ট। মন্দভাগ্য, আমার বন্ধু বান্ধবরা প্রায় সবাই ছিল খানিকটা রোবট টাইপের। তাই অবসরের সেই দুই মাস গোল্লা জায়গাটা কেমন তা জানার প্রবল ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও আমার জানা হয় নি।

অবসর কাটত বই পড়ে, ঘুমিয়ে আর টেলিভিশনের চ্যানেল ঘুরিয়ে। মাঝে মাঝে বই পড়াতেও বিরক্তি আসত। একটানা আর কতই বা পড়া যায়! এক সন্ধ্যায় খুব বিরক্তি নিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, হঠাৎ হাতে একটা কাগজ পেলাম। সন্ধানী স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচির পরিচয় পত্র। আগেই বলে  নেই, সন্ধানী  হল সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র ছাত্রী দ্বারা পরিচালিত একমাত্র রক্তদান সংগঠন। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত এটিই আমাদের দেশে গড়ে ওঠা সামান্য কিছু রক্তদান প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে বহুল পরিচিত। এদের কাজ হল আমার মত কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষদের কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে তা দিয়ে বিনামূল্যে সেবা দেয়া। নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজ।

পরিচয় পত্রটা হাতে পাবার পর উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। ওটা ছিল আমার বড় বোনের। সেখানে সংক্ষিপ্তাকারে  রক্তদানের মহিমা ও তাৎপর্য লেখা।  সব শেষের লাইনটা এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে। লাইনটা ছিল “ আপনার ১৮তম জন্মদিনটি পালন করুন স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে”। হঠাৎ লাইনটা মাথায় ঢুকে গেল। দিনগুল দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু লাইনটা মাথা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছিল না। অপেক্ষা করছিলাম জন্মদিন আসার। আসি আসি করে যখন জন্মদিন এসেই গেল, সেদিন বাঁধল আসল বিপত্তি। একটু খুশি খুশি মন নিয়ে সাজছি আর গুন গুন করে গান গাইছি।

মা জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছি। রক্ত দিতে যাব শুনেই রেগে আগুন, তেলে বেগুন। সম্ভব না। কাউকে রক্ত দিতে হবে না। মা কত কষ্ট করেন আমাদের জন্য। তার প্রশ্ন,এত কষ্টে গড়া রক্ত আমি কেন মানুষকে দেব! পরে না আবার আমার রক্তশূন্যতা দেখা দেয়! আমার মা,চিন্তা তো আমাকে নিয়েই করবে। হয়ত দেশের সব সাধারণ  মানুষেরই রক্তদান নিয়ে এমন ভ্রান্ত ধারণা আছে। তা যদি নাই হবে, তবে দেশে রক্তদাতার সংখ্যা এত কম কেন ! আমরা সচেতন হলে আমার দেশের সাধারণ মানুষ কেন রক্তের অভাবে প্রাণ দেবে! মা কে বোঝানোর হাজার চেষ্টা করলাম ,প্রতি চার মাস পর পর আমাদের শরীরের রক্তকণাগুলো নিজেদের ভেঙ্গে নতুন কোষ তৈরী করে। ফলে নতুন রক্ত তৈরী হয়। টিকটিকির লেজ খসে পড়লে যেমন নতুন লেজ জন্মায়, তেমনি প্রতিটি সুস্থ্য মানুষেরও প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর নতুন রক্ত তৈরী হয়।আগের রক্তগুলো শরীরের ভেতরেই নষ্ট হয়ে যায়,কোন কাজে আসে না। কিন্তু ওই রক্তই নষ্ট হবার আগে শরীর থেকে বের করে নিলে তা অন্য জনের শরীরে জীবন রক্ষাকারী হিসেবে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। মায়ের মন, বুঝল যতটা তার চেয়ে বেশী করল মন খারাপ! মাকে কষ্ট দেয়ায় খানিকটা মন খারাপ নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম।

সন্ধ্যানী তে যাবার পর যখন সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হল, কেবল রক্ত সংগ্রহ করা বাকি,আমাকে জানানো হল আমার রক্ত তারা নেবে না। কেন নেবে না? রক্তের ক্রস ম্যাচিং থেকে শুরু করে সব রকম পরীক্ষা করেই তো তারা বলল সব কিছু নরমাল। তবে রক্ত নেবে না কেন! একজন তখন জানাল যে আমি মাত্র ১৮ তে পা দিলাম। ১৮ পূর্ণ হবার পর তবেই না রক্ত দেয়া যাবে। তার আগে রক্তের কোষগুলো থাকে অপরিণত। এতদূর আসার পর যখন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরব ভাবছি,ঠিক সেই মুহূর্তে এক নতুন  নাটকের অবতারণা। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধ তার ৭ বছরের নাতির জন্য হন্যে হয়ে রক্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথাও রক্ত নেই। অ্যাক্সিডেন্টের ইমার্জেন্সি রোগী। এবার ৬ জোড়া চোখ আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করল।

একজন বলেই বসল, “এই মেয়ে রক্ত দিলে কোন সমস্যাই হবে না। ওজন,উচ্চা ঠিক আছে”। যেই বলা সেই কাজ। এবার ঠিকই নেয়া হল আমার অপরিণত রক্ত। নেয়া হল,কারণ আমার দেশের মানুষ সচেতন না। নষ্টই হয়ে যাবে তবু আমরা সামান্য ৪৫০ মিলিগ্রাম রক্ত অন্য কাউকে দিয়ে দিতে নারাজ। কেন দেব? আমার কি স্বার্থ? যদি এই ই মনে করেন,তবে দাদা কাল নিজের জন্য ও প্রস্তুত হয়ে থাকবেন। আপনার প্রয়োজনেও কিন্তু কাউকে পাশে পাবেন না!

সেই প্রথম অনুভূতি রক্ত দেবার। নিজের ভেতর এতটা ভাল লাগা এর আগে কবে জন্মেছিল ঠিক মনে করতে পারিনা। কিসের জন্য এই ভালোলাগা? কারো উপকার করতে পারার? নিজেকে মহৎ ভাবার সুযোগ পাবার? জানি না। শুধু জানি নিজের কাছেই নিজেকে নায়ক নায়ক মনে হচ্ছিল। নিজের জীবনের নায়ক। আত্মতৃপ্তির চূড়ান্ত। এর পরের গল্পটা সংক্ষিপ্ত। একে একে ১৫ বার রক্ত দেয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলান্টারি সংগঠন সঞ্চালন  থেকে সর্বোচ্চবার রক্তদানের সম্মাননা পাওয়া।

সম্মাননা পাওয়া টা হয়ত সুখের ছিল। কিন্তু এর জন্য আমাকে ১৫ বার মানুষের কষ্ট দেখতে হয়েছে। ১৫ বার ১৫ টি অসহায় পরিবার দেখেছি আমি। মুমূর্ষ,মৃতপ্রায়। ওই করুণ মুখগুলো ওই রোগীর সাথে,রোগীর পরিবারের সাথে আমার এক বন্ধন জুড়ে দিয়েছে প্রতিবার।

রক্ত দেয়ার পর নিয়ম হল ১০ থেকে ১৫ মিনিট শুয়ে বিশ্রাম করা। এই সময়ে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ও অক্সিজেনের ভারসাম্য স্বাভাবিক হয়,ফলে খানিকটা দূর্বল লাগা ছাড়া আর কোন শারীরিক সমস্যা হয় না । ২য় বার যেবার রক্ত দিলাম, তাড়া ছিল খুব। তাই বিশ্রাম না নিয়েই উঠে পড়েছিলাম। তারপর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে দেখু বিছানায় শুয়ে আছি। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়াছিলাম। মাথায় আঘাত পেয়ে আলুর মত ফুলে গেছে।নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলাম,এই জীবনে আর রক্ত দিচ্ছি না!    
কিন্তু পারিনি। নিজের কাছে করা নিজেরই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারিনি আমি।  কারণ ততদিনে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাপিয়ে আমি পড়েছি অন্য বন্ধনে। রক্তের বন্ধন। যেই বন্ধনের কাছে আমি দায়বদ্ধ।

এক বার এক খুব আসহায় আর দুস্থ পরিবার কে গেলাম রক্ত দিতে।শুনলাম আগের দিন এক ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। রক্তের বিনিময় হয়েছে ২৫০০ টাকায়

আপনার মন্তব্য

আলোচিত