হোসেন সোহেল

২০ এপ্রিল, ২০১৮ ১৫:০৪

আটান্ন বছর পর করতালের সন্ধান!

সমুদ্রের ঢেউ ভেঙ্গে ট্রলার এগিয়ে যায় কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে। ট্রলারের শব্দের সাথে পশ্চিম আকাশে সূর্যও ডুবতে থাকে। আরও ঘন্টাখানেক লাগবে সোনাদিয়ার মাটি স্পর্শে। প্রাণিবিদ আনিসুজ্জামান খান, সাগরতলের স্কুবা ডাইভার আতিক রহমানকে নিয়ে এবারের যাত্রা হারিয়ে যাওয়া সামুদ্রিক জলজ-প্রাণ করতালের সন্ধানে। তথ্য মোতাবেক করতাল নাকি আবার ফিরতে শুরু করেছে সোনাদিয়ার চ্যানেলে। তবে সঠিক কোন জায়গায় তা আমাদের জানা নেই। তারপর ও করতালের জীবন চক্রের সকল তথ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি।

করতাল একটি সামুদ্রিক জলজ-প্রাণ । ডুবে থাকে নোনা পানির কাঁদা-বালুতে। গোলাকৃতির চ্যাপ্টা করতাল থেকে পাওয়া যায় সামুদ্রিক মুক্তা। মূল্যবান মুক্তা সংগ্রহের পর করতালের খোলস দিয়ে নির্মিত হয় বড় আকৃতির ঝাড়বাতি বা ঝালর’। শতবছর পূর্বে দরবার হল, বৈঠকখানা বা  রাজপ্রাসাদে ঝুলতো আকর্ষনীয় সে ঝারবাতি। এ কারণে শত বছর আগে সোনাদিয়া থেকে এশিয়া ও আরবের দেশগুলোতে রপ্তনী হতো করতালের মুক্তা ও খোলস।

জোয়ার ভাটা সাগর উপকূলে এদের বসবাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে এরা অন্যতম। ৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে এদের উৎপত্তি। সাগরের জল থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট সংগ্রহ করে এদের দেহের খোলস তৈরী হয়। দুই খোলসের গ্রন্থির  নিঃসরণ থেকে যে গোলাকৃতি দানা তৈরী হয় তা হলো মুক্তা। যা মহামূল্যবান হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত। মুক্তার রঙ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।

পৃথিবীতে প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার প্রজাতির শামুক-ঝিনুক রয়েছে। এদের মধ্যে শ’খানেক প্রজাতির ঝিনুক বা করতাল মুক্তা উৎপাদন করতে পারে। বাংলাদেশে কক্সবাজার উপকূলসহ টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সোনাদিয়া এবং মহেষখালির ঘটিভাঙ্গা এলাকায় এই প্রজাতির করতাল পাওয়া যেতো। অতিরিক্ত সংগ্রহে প্রাণিগুলো বিলুপ্ত হয়েছে এদেশের সমুদ্র উপকূল থেকে।

করতাল সাগরের পরিবেশ ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরা জোয়ার-ভাটা এলাকায় ভূমির উর্বরতা বাড়ায়। বালু ও কাঁদা থেকে চালনির মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র  প্লাংকটন ফাইটো প্লাংকটন খেয়ে সাগরে ক্যালসিয়াম ক্যর্বোনেট তৈরী করে পানির পরিবেশকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

এমন সব আলোচনার সাথে অন্ধকারও ঘন হলো সোনাদিয়ার গা ঘেঁষে। নৌকা নোঙ্গর হলো সোনাদিয়ার বালুচরে। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এ দ্বীপ ককসবাজার  থেকে উত্তর পশ্চিমের সাগর গর্ভে অবস্থিত। সোনাদিয়া মানুষের বসবাসের দুটি পাড়াতে বিভক্ত। একটি পূর্বপাড়া অন্যটি পশ্চিমপাড়া। গোটা হাজার চারেক মানুষের পাড়া দুটোতে। আমরা অবশ্য পশ্চিম পাড়াতে।

রাতে সাগর সৈকতে হাঁটতে গিয়ে জানতে পারলাম স্থানীয়রা করতালকে 'কস্তুরা’ বলে। বলছিলেন সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ। তিনি আরও জানালেন- প্রায় আটান্ন বছর আগে করতাল হারিয়ে যায় সোনাদিয়া থেকে। ষাট সালের পর থেকে কস্তুরা’ আর দেখা যায় না। মাত্রারিক্ত কস্তুরা সংগ্রহ করতে গিয়ে কস্তুরার বংশ ধ্বংস করেছে এলাকাবাসী। হারিয়ে যাওয়া কস্তুরার সাথে জড়িত কোন পেশাজীবি মানুষও আর নেই। সময়ের স্রোতে তারাও হারিয়ে গেছেকরতাল বা কস্তুরার হারিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায়।

বৃদ্ধের কথার সাথে ডক্টর আনিসুজ্জামান খানের কথায় হতাশ হলাম। আটত্রিশ বছর আগে সোনাদিয়ার কোন অংশে করতাল দেখেছিলেন তিনি তা ভুলে গেছেন। তবে কয়েকটি চ্যানলে খোঁজ করলে হয়তো নমুনা পাওয়া যাবে এমন কথায় একটু ধাতস্ত হলাম। সেইসাথে পুঁজি হলো বৃদ্ধের একটি তথ্য ’কালাদিয়া’ চ্যানেল।

চারদিক থেকে সাগরের ঢেউ আছড়ানোর শব্দ কানে আসে।  দেশের পশ্চিমে প্রায় ১৪ কিমি অর্ধ চন্দ্রাকৃতি সোনাদিয়া দ্বীপটি জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। সোনাদিয়ায় অনেক বিরল প্রজাতির পাখিসহ সামুদ্রিক কাছিমের ডিম দেবার অন্যতম স্থান। প্যারাবন বেষ্টিত সোনাদিয়ার পূর্বে চকচকে বালুর সাগর সৈকত আর পশ্চীমে পলি কাঁদাযুক্ত বিশাল এলাকা। এখানে জল ও স্থলভাগের প্রাণিদের জীবন চক্র অতি প্রাকৃতিক। এমন পরিবেশে বাস করে করতাল বা কস্তুরা।

১৯৮৩ সালে জাহানারা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগিতায় ঢাকাতে একটি রপ্তানী বাণিজ্য মেলায় করতালের তৈরী জুয়েলারীসহ জেমস, ষ্টোন ও শেল ক্রাফট প্রর্দশনী হয়। এমন একটি উদ্যোগ ছিলো করতালকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো ও্ চাষযোগ্য করে তোলা। এছাড়াও জাপানি একটি সংস্থা বাণিজ্যিকভাবে ’পার্ল কালচার’ নামে আশির দশকে করতাল থেকে কৃত্রিম মুক্তা উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। শাহপরীর দ্বীপ ও মহেষখালিতে পরীক্ষামূলক সে প্রকল্পের ফলাফলও ছিল ভালো কিন্তু অজানা কারণে সে প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে প্রাণিটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে জোয়ারের পদধ্বনি দেখতে পেলাম। এখনই সময় সোনাদিয়ার চারিপাশে ঘোরাফেরার জন্য। সোনাদিয়ায় রাত-দিন প্রকৃতির শাসন মেনে চলতে হয়। জোয়ারে ট্রলার চলে আবার ভাটায় বন্ধ। পরিবেশ বান্ধব না হলেও সাগর পথে দ্রুত চলাচলে আওয়াজবাহী  ট্রলারের যাত্রা মেনে নিতে হলো।

এক সময় মহেষখালি-সোনাদিয়াতে চলতো পাল তোলা নৌকা। তখন সোনাদিয়ার পরিবেশ ছিল আরও স্বাস্থ্যবান। নির্জন চ্যানেলে পানি কেটে ভরা জোয়ারে কালাদিয়ায় এসে পৌঁছালাম কিন্তু কাজ হলো না। কারন জোয়ারে ফুলে ফেঁপে ওঠা পানি না কমলে বুঝা যাবে না কোনটি চ্যানেল আর কোনটি সাগর। কালাদিয়ার পূর্বে অবস্থান বড়দিয়ার- পশ্চীমে বেলকাদিয়া, সর্ব দক্ষিনে সোনাদিয়া।

জোয়ার অল্প অল্প করে ভাটার সাথে হাত মেলাতে শুরু করলো। স্কুবা ডাইভার আতিকুর রহমান কালাদিয়া চ্যানেলে পানির তলদেশ থেকে ওঠে জানালেন শুধু কাঁদার কথা। তবে করতালের বসবাসে শুধু কাঁদা হলে চলবে না সাথে বালু লাগবে। এরপরও খানিকবার হাতড়িয়ে কালাদিয়া ত্যাগ করলাম। সেইসাথে করতাল অনুসন্ধানের তালিকা থেকে কালাদিয়াকে বাদ দিলাম। জোয়ার আমাদের ঘন্টা দুয়েক সময় দেবে। তাই গন্তব্য পরিবর্তন এাবার ছুটলাম বড়দিয়া’।

’দিয়া’ মানে দ্বীপ। সোনাদিয়ার ভিতরে অনকে দ্বীপের সহ-অবস্থান বিষয়টি বিরল। প্রাণীবিদ আনিসুজ্জামান বলছিলেন শতবছর আগে চাঁদ সওদাগররা সোনাদিয়াতে বাণিজ্য করতে আসতো। দীর্ঘ পথ ভ্রমনে তাদের একত্রে থাকতে হতো অনেকদিন। একঘেয়েমি কাটাতে বিনোদনের জন্য তারা প্রায়শ গান-বাজনা করতো ।

লেখক: পরিবেশ প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত