মিখাপিরেগু

৩০ মে, ২০১৮ ২৩:৫১

চা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও ভূমির অধিকার

সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। সেসময় ব্রিটিশরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে উপমহাদেশে বাণিজ্যিক ফসল হিসেবে চা চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

কিন্তু নতুন এ শ্রমঘন শিল্পে প্রচুর পরিশ্রমী শ্রমিকের দরকার ছিলো যা স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে সম্ভব নয়। ঠিক সে সময় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। আর ঠিক সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় ব্রিটিশরা।

দালালদের মাধ্যমে ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য জায়গা থেকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে (কোনও জায়গায় এটাও বলা হয়েছিল যে মাটি খুঁড়লে বা গাছ নাড়ালে সোনা পাবে বা জায়গাজমি সহ উন্নত জীবন দেয়া হবে) আসামে ও সিলেটে চা বাগানে কাজে আসতে প্ররোচিত করা হয় শ্রমিকদের।

এতো পরিকল্পিত ভাবে প্রতারণা করার কারণ এসব শ্রমিক অপেক্ষাকৃত গরম ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় বসবাসকারী, অশিক্ষিত, নিম্নবর্ণ গরিব-জনগোষ্ঠী স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় বেশি কষ্ট-সহিষ্ণু ও পরিশ্রমী। যেহেতু এঁরা স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি অপরিচিত, তাই তাঁদেরকে দেশ, সমাজ ও পরিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দি-শ্রমিক হিসেবে যুগ যুগ ধরে অল্প মজুরিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও কাজে লাগিয়ে রাখা যাবে।

বাস্তবে হয়েছেও তাই। অতঃপর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে চা শিল্প গড়ে ওঠে আর তার আড়ালে শুরু হয় চা বাগানের নিঃশব্দ কান্না।

চা বাগানের কথা শুনলেই সবার চোখের সামনে উঁচু নিচু সবুজে সারিবদ্ধ ঘন চা গাছের নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। কিন্তু দুটি পাতা একটি কুড়ির এ চা বাগানগুলোতে যাদের জীবনগাঁথা সেই চা শ্রমিক এবং তাদের জীবনধারার নিদারুণ কষ্টের নীরব আর্তনাদ কেউ দেখার চেষ্টা করেনা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বসবাস শুরু করলেও চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের পর।বর্তমানে চা শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ ৩০ হাজার, আর মোট জনসংখ্যা৬ লাখের বেশি৷শ্রমিকদের মধ্যে ৭৫ ভাগই মহিলা শ্রমিক। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির প্রায় ৯৮টি জাতিগোষ্ঠী চা বাগানে বসবাস করে।

কিন্তু সরকারি প্রজ্ঞাপনে সাঁওতাল, মুন্ডা, রাজবংশী, দেশোয়ারাসহ হাতেগোনা কয়েকটি জাতি (যারা সংখ্যায় খুব কম) ছাড়া আর কোনও জাতি অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। যার ফলে চা জনগোষ্ঠীর কেউ সরকারি চাকুরী কিংবা উচ্চ শিক্ষায় আদিবাসী কোটা সুবিধা পায় না।

চা বাগান গুলোতে বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি। ফলে চা বাগানের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা এসব এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ে শুরু হয়। এছাড়াও প্রতিটি চা বাগানেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি সহযোগিতায় মোট ১১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে এসকল বিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষকমন্ডলী যুতসই নয়।

ফলে চা বাগানের শিশুরা যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না। এসব বেশিরভাগ বিদ্যালয়ই এখনো জাতীয়করণ করা হয় নি যার জন্য শিক্ষকদের বেতনভাতা সংক্রান্ত টানাপড়েন থাকছেই।

পড়াশুনা শুরুর পর চা বাগানের শিক্ষার্থীরা আটকে যায় ভাষাগত কারণে। চা বাগানের শিশুরা নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা পরিবারে শিখে এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যাবহার করে। তারপর চা বাগানে সিলেটী, আসামি ও বাংলা ভাষার মিশ্রণে অদ্ভুত এক ভাষা প্রচলিত আছে সেটাকে স্থানীয়ভাবে জংলি ভাষা বলা হয়। চা শ্রমিকরা নিজস্ব ভাষায় পরিবারে এবং নিজ জাতির মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করে কিন্তু অন্য জাতির সাথে এই জংলি ভাষা ব্যাবহার করে।

তবে কালক্রমে এখন চা শ্রমিকরা সিলেটী শিখে ফেলেছে তবে শুদ্ধ করে পারেনি। আর বাংলা উচ্চারণে চা শ্রমিকেরা এখনো পারদর্শী নয়। তাই পড়াশুনার শুরুতে ভাষাগত বৈষম্যে ছিটকে পড়ে পরে ভাষা আয়ত্ত হলেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। বাঙ্গালিদের কাছে ইংরেজি শিখতে যেমন সমস্যা হয় তেমনি চা বাগানের শিক্ষার্থীদের বাংলা শিখতেও সমস্যা হয়। সর্বশেষ প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা বলা আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কেউ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরুলেই ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রধানত দারিদ্র্যতার কারণে বেশিরভাগ ছেলে মেয়েকেই জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এ লড়াই বেঁচে থাকার। যে সকল শিক্ষার্থী দারিদ্র্যতার সাথে পেরে উঠতে পারে তারা স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজেও পড়ছে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিকে ভালো ফল না থাকায় অনেকেই ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারে না। এমনিভাবে উচ্চ মাধ্যমিকেও ভাল ফল না থাকায় সরকারি কলেজেও সুযোগ পায় না। ফলে যারা নিজস্ব আগ্রহে পড়তে চায় তারা ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হয়।

কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক উচ্চ শিক্ষায় এই ঝড়ে পড়ার হার অনেক বেশি। কারণ কলেজ পেড়িয়ে অনেক যুবক-যুবতিকেই সংসারের হাল ধরতে হয় ফলে আর পড়াশুনা হয় না। যারাও অবশিষ্ট থাকে তারা সরকারি কলেজগুলোতে পড়ে। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সুবিধা না পাওয়া, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল না করা, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে প্রস্তুতি নিতে না পারা এসকল নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার শিকার চা বাগানের শিক্ষার্থীরা তবুও থেমে থাকে না।

তুখোড় মেধা ও প্রবল অবিশ্বাসের বলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৩ জন চা বাগানের শিক্ষার্থী ঢাবি, জাবি, জবি, রাবি, বেরোবি, কুবি, শাবিপ্রবি, সিকৃবি, ঢাকা মেডিকেল, সিলেট মেডিকেল পড়ার যোগ্যতা অর্জন পেয়েছে। যথাযথ যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে চা বাগানের শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে থাকবে না। অচিরেই চা বাগানের শিক্ষার সংকট নিরসনে বেশ কিছু দাবি সামনে আসে

দাবিগুলো হলো :
১. প্রতিটি চা বাগানে একটি করে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন।
২. চা বাগানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।
৩. মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৪. সরকারি ভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/ আদিবাসী হিসেবে কোটার সুবিধা দেয়া।
৬. বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থাসহ কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি।
৭. চা বাগান এলাকায় সরকারি কলেজ স্থাপন।

চা শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে ভূমির অধিকার থেকে। চা শ্রমিকেরা চা বাগান কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত এক চালা আধা কাঁচা ঘরে থাকে। বসবাস অযোগ্য এসব ঘরে গবাদি পশুসহ রান্নার কাজও চালিয়ে নিতে হয়। প্রতিকূল আবহাওয়াতে অবস্থা আরও খারাপ হয়।

তবে বাগান কর্তৃপক্ষ বছরে একবার মেরামত সহায়তা দিলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল। আর পয়নিস্কাশন এবং স্যানিটেশন পরিস্থিতি চরম জঘন্য। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে প্রায় ২০০ বছর ধরে বসবাস করা বর্তমানে এই ৬ লাখ জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই দেয়া হয় নি।

২০০৭ সালে জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এই ঘোষণাপত্রে ৪৬টি ধারা রয়েছে। ১ ধারায় বলা হয়েছে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত যেভাবেই হোক আদিবাসীরা জাতিসংঘ সনদ, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনগুলোয় বর্ণিত সব অধিকার ভোগ করবে।

এই ঘোষণাপত্রের ১০ ধারায় এসেছে জোর করে আদিবাসীদের তাদের এলাকা থেকে বা ভ‚মি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। পাশাপাশি ঘোষণাপত্রের বলে আদিবাসীরা নিজেদের পড়াশোনা এবং কৃষ্টির লালন-পালন করতে পারবে। ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারা মতে যেসব ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় বা ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল করে আসছে, তা তাদের অধিকারে।

রাষ্ট্র এগুলোর আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে মর্মে ঘোষণাপত্রে বলা আছে। মোদ্দা কথা, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের ৪৬টি অনুচ্ছেদের ১৩-১৯ অনুচ্ছেদের মধ্যে ভ‚মির অধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখলে থাকা ভূমির ওপর মালিকানা ও ভোগদখলের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের জীবনধারণ ও ঐতিহ্যগত কার্যক্রমের জন্য প্রথাগতভাবে প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন ভূমি ব্যবহারের অধিকার সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে যাযাবর জনগোষ্ঠী ও জুম চাষিদের অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর প্রদান করতে হবে। ভূমি সমস্যা নিরসনের জন্য জাতীয় আইনি ব্যবস্থার মধ্যে পর্যাপ্ত কার্যপ্রণালী গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভ‚মি অবৈধ দখল ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনে পর্যাপ্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সরকার এ ধরনের অপরাধ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

জাতিসংঘের সদস্য ১৪৩টি দেশ এ ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এশিয়ারও প্রায় সব দেশ ঘোষণার পক্ষে ভোট দিয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, এমনকি পাকিস্তান পর্যন্ত আদিবাসী ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

আর আদিবাসী অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণাপত্র যা আছে তা হলো- জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র, ২০০৭; নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সনদ, ১৯৬৬; আইএলও কনভেনশন নম্বর ১০৭ও ১৬৯; শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৬; জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ঘোষণাপত্র, ১৯৯২।

এসব ছাড়াও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, ইউনেস্কোর বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণা, ভিয়েনা বিশ্ব সম্মেলন, জীববৈচিত্র সনদ এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন দলিলে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, এডিবি, ইফাড, ডানিডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অনেকের আদিবাসী বিষয়ে পলিসি আছে। এসব সনদ ও ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের কথা গুরুত্ব পেয়েছে। ১০৭ আইএলও কনভেনশনে ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির ওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।

ইদানীং আদিবাসীদের ভূমি করাল গ্রাসের শিকার। তারা ভূমি রক্ষা করতে পারছে না, কেননা আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন হচ্ছে না এবং এসবের আলোকে কোনো আইনও নেই।

যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ১০৭ কনভেনশন অনুসমর্থন দিয়েছিলেন। তবে তেমন কোনো কাজ এরপর আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি।

বলা যেতে পারে, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকার এখন পর্যন্ত স্বীকার করে নেয়া হয়নি। একই আইএলও কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১২-তে বলা হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা বা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত কারণে দেশের আইন বা বিধি ব্যতিরেকে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে তাদের আবাসভূমি থেকে স্বাধীন সম্মতি ছাড়া বাস্ত্যুচ্যুত করা যাবে না। যদি সরাতেও হয়, তবে পূর্ণ সম্মতিতে নিশ্চয়তাসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার পরে তাদের স্থানচ্যুত করা যাবে। আন্তর্জাতিক বিধান এটাই বলে।

কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৩-তে এসেছে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্য নয় এমন ব্যক্তিদের এসব প্রথার সুযোগ গ্রহণ বা এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আইন সম্পর্কিত অজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জমির মালিকানা লাভ বা ব্যবহার করা থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মোটামুটি ভাবে বলা চলে, আদিবাসীদের ভূমির ওপর সমষ্টিগত মালিকানার স্বীকৃতি রয়েছে। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৪-এর ধারা ২২.১ ও ২২.২-এ আদিবাসীদের ভ‚মি সুরক্ষা, পার্বত্য চুক্তির অবশিষ্টাংশ বাস্তবায়নসহ তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসীদের ভূমি অনাদিবাসীদের কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিমালা থাকার পরও আদিবাসীরা ভূমি অধিকার পাচ্ছে না। যার ফলে চা শ্রমিকেরাও ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দেশে ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২টি, সিলেটে ১৯টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি, চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙ্গামাটিতে ১টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান।

বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন চা বাগান হলেও এসব চা বাগানের ভূমির মালিক রাষ্ট্র। উৎপাদন আর ব্যবস্থাপনার দিক বিবেচনা করে এসব চা বাগান বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা দেয়া হয়। ইজারা হিসেবে সরকারকে প্রতি বছর দিতে হয় মাত্র ৫০০ টাকা।

কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব চা বাগান কোটি কোটি টাকায় কেনা বেচা হয়। এছাড়া চা বাগানের ভূমি দখলের পায়তারা আছেই। ব্যক্তিগত প্রভাবশালীরা যেমন এতে যুক্ত তেমনি সরকারও। সিলেটের তারাপুর চা বাগানের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ।

সাম্প্রতিককালে চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর-বেগমখান চা বাগানের ৫১১.৮৩ একর কৃষি জমিকে সরকার “অকৃষি খাস জমি” দেখিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। সরকার এই যায়গায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলতে চায়। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করলে তারা এই জমিতে চা শ্রমিকদের অধিকার অস্বীকার করে। পরে দীর্ঘ তিন মাস দুর্বার আন্দোলনে সরকার পিছু হটে। এভাবে যেকোনো অজুহাতে মালিক পক্ষ বা সরকার চা শ্রমিকদের জমি কেড়ে নিতে পারে।

তাই অচিরেই চা শ্রমিকদের ভূমি রক্ষার ব্যাপারে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। কারণ ভূমি অধিকার একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। তাই চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ লক্ষে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা আবশ্যক:

১. চা বাগানে শ্রমিকদের ভ‚মি অধিকার দিতে পৃথক ভ‚মি কমিশন গঠন।
২. চা শ্রমিকদের জন্য বাসযোগ্য পাকা বাড়ি তৈরি।
৩. সরকারি বেসরকারিভাবে ভূমি দখলের বিপক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা।
৪. সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকায় চা বাগান কেনা বেচার পায়তারারোধ করা।

অন্যান্য আদিবাসীদের মতো চা শ্রমিকদের শিক্ষা ও ভূমির অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে হরণ করা হচ্ছে। ২০০ বছর ধরে যে শ্রমিকেরা নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নের পরও দেশের একটি প্রধান রাপ্তানিযোগ্য শিল্পের বিকাশ ঘটাল সে শ্রমিকেরা ন্যুনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত।

একটি অমানবিক বৈষম্যের কথা বলে লিখাটি শেষ করছি। ব্রিটিশরা চা শ্রমিকদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে অদ্ভুত এই ব্যবস্থা চালু করেছিল কারণ তারা চা শ্রমিকদের আজন্ম দাস বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। চা বাগানগুলোতে ম্যানেজারকে 'সাহেব' এবং বিভিন্ন কর্মকর্তাদের 'বাবু' বলে সম্বোধন করা হয়।

এদিকে চাকুরীর সুবিধা হিসেবে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের স্টাফ কোয়ার্টার, গাড়ির জ্বালানি খরচ এবং ম্যানেজারকে বাংলো ও বিলাসবহুল গাড়ি দেয়া হয়। অপরপক্ষে চা শিল্পের মূল কারিগর চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখন ৮৫ টাকা। ২০১০ সালে ছিল ৪৮ টাকা। আরও দেয়া হয় নিম্নমানের খাবার অযোগ্য রেশন।

ব্রিটিশদের চালু করা স্বৈরশাসনের এই বিশেষ ব্যবস্থা আজও চা বাগানগুলোতে বিদ্যমান আছে এবং এই স্বাধীন রাষ্ট্র তার পৃষ্ঠপোষক। এমন বিপন্ন মানবিকতার ফলশ্রুতিতে চা শ্রমিকদের মানবাধিকার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত।

প্রায় ৬লাখ এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ব্যতীত সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ আমরা কখনো পাবো না। এর জন্য প্রথমেই চা শ্রমিকদের শিক্ষা এবং ভূমির অধিকার নিশ্চিত হওয়া জরুরী। অন্যথায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির আড়ালেই থেকে যাবে চা শ্রমিকের নিঃশব্দ কান্নার এই করুণ ইতিহাস।

  • মিখাপিরেগু: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত