আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০৯:৫৩

স্টেডিয়ামে বোমা, জীবন বাঁচালো একটি মোবাইল ফোন

বড়সড় চেহারার সিলভেস্টার তখনও কাঁপছেন। তাঁর পা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে পেটের কাছ থেকেও। তবে সে সব জখম নেহাতই নগণ্য।

বোমার সব চেয়ে বড় যে টুকরোটা উড়ে এসেছিল, সেটা যদি লাগত- নির্ঘাত উড়ে যেত মাথাটা। কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছে মোবাইল ফোনটা। হাত থেকে ছিটকে পড়া ভেঙেচুরে যাওয়া মোবাইলটা খুঁজে পেয়েছেন সিলভেস্টার। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে সেটা। ফোনটা কুড়িয়ে হাতেই ধরে রেখেছেন। জনে জনে দেখাচ্ছেন। এই ফোনটাই আজ প্রাণ বাঁচিয়েছে তাঁর।

হোক না বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ, বিপক্ষ যে চিরশত্রু জার্মানি। কাজকর্ম সেরে আরও প্রায় ৮০ হাজার ফরাসি ফুটবল-পাগলের মতো সিলভেস্টারও এসেছিলেন জাতীয় স্টেডিয়াম স্তাদ দো ফ্রঁস-এ। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ এসেছেন খেলা দেখতে। স্বভাবতই কঠোর নিরাপত্তার বলয়ে মোড়া স্টেডিয়াম। প্রথমার্ধের খেলা যখন মিনিট কুড়ি, এক বন্ধুর ফোন: কেমন দেখছ? উচ্ছ্বসিত সিলভেস্টার তাঁকে বলেন, ‘‘এর পরে তো ইউরোপীয় কাপ হবে এখানে। ব্যবস্থা তাই দুর্দান্ত। জার্মানদের হারিয়েই আজ মাঠ ছাড়ব। তার পরে উইকএন্ডের দু’দিন ধরে হবে উদযাপন!’’

ফোন কেটেছেন সবে। চোখের সামনে একটা আলোর ঝলকানি। সঙ্গে বিকট শব্দ। বুলেট গতিতে কিছু একটা উড়ে এসে লাগল মুখের সামনে ধরা ফোনে। হাত থেকে ছিটকে উড়ে গেল সেটা। ছোট ছোট কিছু ছররা এসে বিঁধল পায়ে, পেটে। প্যারিসে ধারাবাহিক হামলার এটাই প্রথম বিস্ফোরণ। ঘড়িতে স্থানীয় সময় ঠিক রাত ৯টা ১৭ মিনিট। হইহল্লা ছাপিয়ে স্টেডিয়াম ভরা মানুষের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে সেই আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি। তার মধ্যেই স্টেডিয়ামে উড়ে এল হেলিকপ্টার। নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে তাতে উঠে মাঠ ছাড়লেন প্রেসিডেন্ট। খেলা কিন্তু চলছেই।

‘জে’ নম্বরের গেটের কাছে যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, তার একেবারে উল্টো দিকে বসা প্যাট্রিক বলছিলেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম নেহাতই পটকা। এত নিরাপত্তার মধ্যে বোমা ঢুকবে কোথা দিয়ে? তখনও তো আমরা জানি না, আততায়ী জ্যাকেটে বিস্ফোরক ভরে এনে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। অন্তত তিন জন মারা গিয়েছেন!’’ কিন্তু হঠাৎই মাইকে ঘোষণা শুরু হল, বাইরে কিছু ঘটনার জন্য নিরাপত্তার কড়াকড়ি করা হয়েছে। কয়েকটি গেটের নাম উল্লেখ করে বলা হতে লাগল, এখান দিয়ে কেউ বেরোনোর চেষ্টা করবেন না। তখনই আশঙ্কার কুয়াশা নেমে এল স্তাদ দো ফ্রঁস-এ।

ঠিক সেই সময়েই, প্রথমটির কয়েক মিনিট বাদে ফের বিস্ফোরণ। এ বার ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাঁর ঠিক সামনে। এ বারের শব্দ আরও জোরে। আরও বেশি ধোঁয়া। তত ক্ষণে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও অনেকের ধারণা ছিল ভয়ের কিছু নেই, এ সব নেহাতই ফুটবল পাগলদের ফাটানো পটকা। এর পরে অনেকের ফোনে আসতে লাগল খারাপ খবর। বাইরে বেশ কয়েক জায়গায় জঙ্গিরা হানা দিয়েছে। গুলি চলছে, বোমাও ফাটছে। শুরু হল মাঠা ছাড়া। ভিড়ের চাপ এড়াতে নিরাপত্তা বাহিনী জনতাকে মাঠে নেমে আসতে দেয়। কিছু ক্ষণ খেলা বন্ধ থাকে। তার পরে আবার তা শুরু হয়।

শেষ বাঁশি বাজার সময়েও দু’দেশের খেলোয়াড়রা কেউই জানতেন না মাঠে ঠিক কী ঘটেছে। পুলিশের অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড যখন ঘিরে ধরে খেলোয়াড়দের সাজঘরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা জানতে পারেন আত্মঘাতী হামলার খবর। দুই আততায়ী-সহ অন্তত পাঁচ জন মারা গিয়েছেন। হামলা হয়েছে বাইরেও।

খেলার আগেই বোমা থাকার খবরে হোটেলের ঘর ছাড়তে হয়েছিল জার্মান খেলোয়াড়দের। পরে সারা রাত তাদের স্টেডিয়ামের সাজঘরে থাকতে হয়েছে। জার্মান ম্যানেজার জোয়াকিম লো বলেন, ‘‘খবর শোনার পর থেকেই আমার ছেলেরা ছটফট করছে। যা ঘটেছে তা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়!’’

সিলভেস্টার-প্যাট্রিকরা কিন্তু জিতেই মাঠ ছেড়েছেন। সদ্য সন্ত্রাসবাদী হামলায় ক্ষতবিক্ষত ফ্রান্স ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানিকে। কিন্তু আতঙ্কের আবহে সে জয় উদযাপনের কথা আর ভাবতেও পারছেন না কেউ!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত