আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:৪৩

সন্ধ্যায় রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, যোগ দেবেন বিশ্ব নেতারা

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার পুলিশ, শত শত সেনা আর বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছেন। চাঁদের আলোতে মহড়া দিয়েছেন সেনারা। আজ সোমবার রানীর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে জাতীয় শোকের একটি সেরা দর্শনীয় প্রদর্শন, খুব সম্ভবত বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় চিরবিদায়ের আয়োজন। বিশ্বনেতাদের সবচেয়ে বড় সম্মিলনও ঘটছে এ উপলক্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য লন্ডনে সমবেত হচ্ছেন। প্রায় ৫০০ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং রাজপরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে লন্ডনে পৌঁছেছেন। তিনি গতকাল রোববার পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক ওয়েস্টমিনস্টার হলে রানীর কফিনে শ্রদ্ধা জানান।

শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে থাকছেন দুই হাজার অতিথি ও চার হাজার সেবক। টেলিভিশনে এ অনুষ্ঠান দেখবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।

রানীর কফিনটি হীরা-খচিত মুকুট দিয়ে আবৃত অবস্থায় রাখা হয়েছে। কফিনে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গতকালও হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তীব্র শীতের মধ্যে অনেকে ১৭ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। টেমস নদীর ধারে এবং শহরের দক্ষিণ-পূর্বে সাউথওয়ার্ক পার্কে আট কিলোমিটার দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। রাজা চার্লস এবং প্রিন্স উইলিয়াম শনিবার অঘোষিত সফরে লাইনে থাকা লোকদের অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করেন। আজ সকাল পর্যন্ত সর্বসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন।

৭০ বছর শাসন করা রানী গত ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তাঁকে স্মরণ করার জন্য যুক্তরাজ্যজুড়ে রোববার সন্ধ্যায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আজ সোমবার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্র্রচার করা হবে এবং সারাদেশে পার্ক এবং জনসমাগমের স্থানেও প্রদর্শিত হবে। অনুষ্ঠান দেখানো হবে অন্তত ১০০ সিনেমা হলেও।

রানীর রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে বিবিসি একুশ শতকের 'অতুলনীয়' ঘটনা হিসেবে অভিহিত করছে। একজন কূটনীতিক বলেছেন, 'এটি শতাব্দীর (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) শেষকৃত্য। প্রত্যেক বিশ্বনেতা এটি দেখতে এবং তাঁকেও যেন দেখা যায় তা চাইবেন। যাঁরা এখানে থাকবেন না বা যাঁদের দেখা যাবে না তাঁরা আমাদের সময়ের সেরা ফটোসেশনের সুযোগ হারাবেন।

কূটনীতিকরা বলছেন, রানীর রাজত্বকাল ও তাঁর কূটনৈতিক খ্যাতি ছিল অতুলনীয়। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই শেষ বিদায়ের আয়োজন করা হচ্ছে, যার সঙ্গে সাম্প্র্রতিক কোনো আয়োজনের তুলনাই হবে না। রানীর মৃত্যুর পর যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে তার সূক্ষ্ণ নিখুঁত পরিকল্পনায় জীবদ্দশাতে তিনি নিজেও ছিলেন।

রানীর কফিনটি আজ শেষকৃত্যের জন্য নিকটবর্তী ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে স্থানান্তরিত হবে। এর মাধ্যমে ব্রিটেনের দীর্ঘতম রাজত্বকারী রানীর জন্য ১০ দিনের জাতীয় শোকের সমাপ্তি ঘটবে। অ্যাবেতে ধর্মীয় আচারের পরে রানীর কফিনটি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে লন্ডনের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর এটিকে উইন্ডসরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে রানীকে তাঁর প্রয়াত স্বামীর সঙ্গে সমাহিত করা হবে।

রানীর শেষ বিদায়ের আয়োজনে যোগ দিতে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীরা ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেও উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার এবং ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাতারেলাও উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইউরোপজুড়ে রাজপরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন।

তবে সবার নজরে ছিল গতকাল বাকিংহাম প্যালেসে রাজা তৃতীয় চার্লস আয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা। অনেক নেতার জন্য এটি তাদের সম্মিলিতভাবে দেখা করার এবং কিছু কূটনীতিতে জড়িত হওয়ার একমাত্র সুযোগ।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স এবং কার্যত দেশটির মূল শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানকে আমন্ত্রণ ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া চীন সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের কারণে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোরও বিরোধিতা করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

শেষকৃত্যের আমন্ত্রণ তালিকায় রাজনীতি আর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশও আছে। অল্পসংখ্যক দেশকে অতিথির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও বেলারুশ আমন্ত্রণ পায়নি। সিরিয়া, মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও ভেনিজুয়েলাও তালিকায় নেই। উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু দেশের নেতাদের বাদ দিয়ে কেবল রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানিয়ে শীতল সম্পর্ক প্রকাশ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ রানীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা শেখ হাসিনার : লন্ডনে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে ছোট বোন শেখ রেহানা এবং লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহাসিক ওয়েস্টমিনস্টার হলে যান শেখ হাসিনা। পরে রানীর মৃত্যুতে ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে খোলা শোক বইয়েও তিনি সই করেন।

শেখ হাসিনা ওয়েস্টমিনস্টার হলে প্রয়াত রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এখানে ব্রিটিশ স্পিকারের প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছোট বোনকে স্বাগত জানান।

পরে শোক বইয়ে বাংলায় শোকবার্তা লেখেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, 'আমি বাংলাদেশের জনগণ, আমার পরিবার এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহানার পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।'

এরপর প্রধানমন্ত্রীকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তিনি টেলিভিশনের সামনে রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভিকি ফোর্ড তাঁকে স্বাগত জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রয়াত রানীর সঙ্গে ৮-৯ বার দেখা করেছিলেন এবং রানী তাঁকে তাঁর প্রথম নামেই চিনতেন।

শেখ হাসিনা বলেন, 'রানী আমার কাছে একজন মাতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আমি আমার মায়ের মতো একজনকে হারিয়েছি।' প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রানী ছিলেন একজন বিশ্ব অভিভাবকের মতো এবং তাঁর মৃত্যুতে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটিশ নাগরিক শেখ রেহানা শোক বইয়ে লিখেছেন, 'তিনি আমাদের হৃদয়ের রানী এবং সর্বদা তাই থাকবেন।' সূত্র : বিবিসি, এপি, এএফপি ও বাসস।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত