অনলাইন ডেস্ক

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০১:১৪

মরক্কোয় ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে

মরক্কোয় ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে

মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৩৭-এ পৌঁছেছে বলে মরক্কোর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৬৭২ জন আহত হওয়ার খবর জানা গেছে, যাদের মধ্যে ২০৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ মানুষ মারা গেছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে পৌঁছনো বেশ কঠিন।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মারাকেশ শহর থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরে অ্যাটলাস পর্বতমালা এলাকার ১৮.৫ কিলোমিটার গভীরে।

স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১১ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানার পর লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ভূমিকম্পটির ১৯ মিনিট পর আবারও ৪.৯ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের ভিডিও দেখা যাচ্ছে, তবে এগুলোর সত্যতা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশেষ করে ভবন পড়ে যাচ্ছে—এমন কিছু ভিডিও দেখা গেলেও সেগুলো যাচাই করা যায়নি।

তবে লোকজনকে সতর্ক সংকেত শুনে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে দেখা গেছে। একজন স্থানীয় কর্মকর্তা তার এলাকাতে অন্তত ৩০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন। মারাকেশ শহরের পুরনো অংশে কিছু ভবন ধসে পড়েছে বলে সেখানকার একজন অধিবাসী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

এদিকে মরক্কোতে যেন মানবিক সহায়তা পাঠানো সহজ হয়, সে জন্য আলজেরিয়া তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব চলার পর ২০২১ সালে আলজেরিয়া মরক্কোর সঙ্গে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে ভূমিকম্পের পর আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্সি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ভ্রাতৃপ্রতিম মরক্কান মানুষকে সহায়তার জন্য’ তারা মানবিক সহায়তা ও লোকবল সরবরাহ করতে প্রস্তুত।

ভেবেছিলাম সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে
ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কাটি যখন অনুভূত হয়, মারাকেশে ছুটি কাটাতে যাওয়া ব্রিটিশ নাগরিক আযা লেমার তখন শহরের রাস্তায় হাঁটছিলেন। বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, শহরে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। লেমার বলেন, ‘আমি অনুভব করছিলাম যে মাটি কাঁপছিল।

দেখতে পাচ্ছিলাম যে রাস্তার পাথর সরে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড আগে পার করে আসা একটি বাড়িকে দেখছিলাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে।’

ভূমিকম্পের সময় মারাকেশ থেকে ২২০ কিলোমিটার দূরের বন্দরনগর কাসাব্লাংকাতেও কম্পন অনুভূত হয়। কাসাব্লাংকা শহরের একজন বাসিন্দা লা মাতিন পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ওই সময় আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা কেঁপে ওঠে। আমি ভেবেছিলাম চোর এসেছে। পরমুহূর্তেই শুনি প্রতিবেশীরা চিৎকার করছে। এরপর আমরা বের হয়ে আসি বাড়ি থেকে। এখন অনেক মানুষই মানুষ খোলা জায়গায় থাকছে। সবাই ভয় পাচ্ছে আরো একটি কম্পনের। পাশাপাশি চোর-ডাকাতের আতঙ্কও রয়েছে।’

মরক্কো এর আগেও বেশ কয়েকবার ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে পড়েছে। ২০০৪ সালে দেশটির উত্তর-পূর্বের আল হোসেইমা অঞ্চলে ভূমিকম্পে ৬২৮ জন মারা গিয়েছিল। আর ১৯৬০ সালে আগাদির অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত ১২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এর থেকে ধারণা করা যায়, এবারের ভূমিকম্পেও হতাহতের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বাড়তে পারে।

মরক্কোর এবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল অ্যাটলাস পর্বতমালার মধ্যে। ওই অঞ্চলে এমন অনেক দুর্গম গ্রাম রয়েছে যেখানে পৌঁছনো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। কাজেই এই ভূমিকম্পের আসল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী, তা নিশ্চিতভাবে জানতে বেশ কয়েক দিন লেগে যাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ভূমিকম্পে ২৯৬ জন মারা গেছে আল হৌজ, মারাকেশ, আজিলালসহ কয়েকটি শহরে।’ এ ছাড়া আরো ১৫৩ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় মানুষ বলছে, ভূমিকম্প-পরবর্তী কম্পনে লোকজন এখনো ঘরের বাইরে রাস্তা বা খোলা জায়গায় অবস্থান করছে। আব্দেলহাক আল আমরানি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘মানুষ ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত। শিশুরা কাঁদছে ও তাদের অভিভাবকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।’ তিনি জানান, বিদ্যুৎ ও ফোন সংযোগ প্রায় ১০ মিনিটের মতো বন্ধ ছিল। এএফপি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি পরিবারের আটকে পড়ার খবর দিয়েছে। এ ছাড়া অনেক মানুষকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অ্যাটলাস পর্বতমালার অনেক দূরের একটি এলাকায় হলেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে সেখান থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী রাবাত ছাড়াও কাসাব্লাংকা ও এসাউইরাতে। উৎপত্তিস্থলের কাছে পর্বত এলাকার সাধারণ ভবনগুলো হয়তো টিকে নেই এবং অনেক দূরের এলাকা হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সময় লাগতে পারে।

দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরেজমিন অনুসন্ধানের পর জানিয়েছে, ভূমিকম্পে বহু পুরনো ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজধানী রাবাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দেলোয়াফি লাফতিফ সংবাদ সম্মেলনে জানানম, ক্ষতিগ্রস্তদের একটা বড় অংশই রয়েছে দুর্গম এলাকায়।

সেসব এলাকায় অনেক পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। মারাকেশের হাসপাতালগুলোতে বিপুল পরিমাণে মানুষ আসছে এবং তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে নাগরিকদের রক্তদান করার আহ্বান জানিয়েছে শহরের কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং মরক্কোকে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ জানিয়েছেন, তার দেশ মরক্কোকে ‘প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত’। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি তার দেশ সহায়তার জন্য প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিসের এক বার্তায় বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু ‘মরক্কোর মানুষকে সকল প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ’ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি এক্সে মন্তব্য করেছেন, ‘যুক্তরাজ্য সম্ভাব্য সকল পন্থায়’ মরক্কোকে সহায়তা করবে। এ ছাড়াও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সাঞ্চেজসহ বিশ্বনেতারা সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।

ভৌগোলিক অবস্থানের হিসাবে মরক্কো আফ্রিকা আর ইউরোপের মধ্যে রয়েছে। আফ্রিকা ও আরববিশ্বের ওপর এই দেশটির প্রভাব রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের উপকূল রয়েছে এই দেশটির সঙ্গে। দেশটির মধ্যে রুক্ষ পাহাড়ও রয়েছে এই দেশের সংস্কৃতিতে আরব, বেরবার, ইউরোপীয় ও আফ্রিকান প্রভাব রয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ এবং আয়তন প্রায় সাড়ে চার লাখ বর্গকিলোমিটার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত