নিজস্ব প্রতিবেদক

১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:৫৮

তাঁরা চা শ্রমিক, তাই শহীদদের তালিকায়ও নাম নেই!

১৯ এপ্রিল। সোমবার। ১৯৭১। খাদিম নগরের সবুজ চা বাগান লাল হয়ে উঠে শ্রমিকের রক্তে। এদিন সিলেট নগরীর উপকণ্ঠের এই চা বাগানের ২১ শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। আহত হন আরো অনেকে। এরকম অযুত প্রাণের রক্তের বন্যায় ভেঙ্গে যায় পাকিস্তান নামক একটি নোংরা বাঁধ। আসে কাম্যবস্তু স্বাধীনতা।

এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্তি হলো এবার। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষা চলছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পুরষ্কার স্বরুপ কে কী পেলেন, কার গলায় কত বড় মেডেল, কত বড় পদক ঝুললো তা নিয়ে দেনদরবার চলছে। সরকার বদলের সাথে বদলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। ৪৪ বছরে পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাষ্ট্রকে ধোকা দিয়ে চলছে তস্কর আমলারা।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ফাণ্ড, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, চাকরী বা ভর্তিক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য বিশেষ কোটা..., কত কী! কতকিছুই হচ্ছে! ঘটছে! এই ফাঁক দিয়ে রাজাকারাও মন্ত্রী হয়ে গিয়েছিলো। গাড়িতে উড়িয়েছিলো দেশের পতাকা।

অথচ খাদিমনগর চা বাগানে দেশের জন্য আত্মদানকারী ২১ শহীদের কথা ভুলেই গেছে বাংলাদেশ। সরকার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাগান কতৃপক্ষ কেউই মনে রাখে নি এই শহীদের। শহীদের তালিকায়ও নাম নেই এঁদের। নেই বলার মতো কোন স্মৃতিচিহ্নও।

রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তা তাদের কথা না হয় বাদ দেওয়া যাক। তারা অনেক ব্যস্ত মানুষ! আরো অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে তাঁদের ব্যস্ত থাকতে হয়! চা বাগানের কোন শ্রমিক কবে কীভাবে শহীদ হয়েছ, আদৌ হয়েছে কী না- তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় কই! কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ! যে বাগানে কাজ করতেন এই শহীদরা সেখানকার কর্মকর্তারাই মনে রাখেননি তাঁদের কথা। তাদের নামও জানেন না কেউ। এ ব্যাপারে বাগান কতৃপক্ষের বক্তব্য খুবই দায়সারা।

২১ শহীদের ব্যাপারে খাদিমনগর চা বাগানের ব্যবস্থাপক বলেন, ঘটনাটি পাশ্ববর্তী বড়জান চা বাগানের ভেতরে ঘটেছে। স্মৃতিসৌধটিও ঐ বাগানের আওতাধীন। ফলে এ ব্যাপারে আমার তেমন কিছু জানা নেই।

বড়জান চা বাগানের ব্যবস্থাপক মুন্না আহমদ বলেন, এটি শ্রমিকদের ব্যাপার। ঘটনাটিও অনেকদিন আগের। তাই এ ব্যাপারে আমার কোন ধারনা নেই।

দেশের জন্য জীবন দিয়েও শেষপর্যন্ত ‘শ্রমিক’ই থেকে গেলেন এই শহীদেরা!

একাত্তরের সেই দিনে পাক হায়েনারা খাদিমনগর চা বাগানে প্রবেশ করে ২২ জন শ্রমিককে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেদিন খুন হন ২১ জন। একজন বেঁচে যান। এই বেঁচে যাওয়াকে কী বলা যায়! ভাগ্যগুণে? পাকিস্তানিদের বন্দুকের মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানের নাম নারায়ণ বল্মিক দাস (৬৫)। তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক সেদিনের ঘটনার বিবরণ।

‘তখন সকাল ১১ টা বাজে। এদিন মজুরী দেওয়ার কথা বলে চা বাগানের সকল যুবক শ্রমিকদের একটি কক্ষে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু কক্ষে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন বিষয়। সৈন্যরা বাংলাদেশ নাম বলে বলে গালি দিতে থাকে ও তাদের বুট দিয়ে লাথি দিতে থাকে। এসময় পাক সেনারা চা শ্রমিকদের তাদের গুলি বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। শ্রমিকরা এতে রাজী না হওয়ায় শুরু হয় গালিগালাজ। এসময় ঘরের মধ্যে একধরনের গ্যাস ছেড়ে পুরো ঘরকে অন্ধকার করে দেওয়া হয়। ঘরের ভেতরে অন্যদের দেখা যাচ্ছে না। স্পর্শ না হলে বুঝা যাচ্ছে না আশেপাশে কেউ আছে কী না। এ অবস্থায় পেছনের জানালা দিয়ে গুলি করা শুরু হয়। গুলি এসে কার উপর বিদ্ধ হলো, কে মারা গেল কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর কেবল থেমে থেমে প্রকাণ্ড শব্দ আসছিলো কানে। গুলির শব্দ। সাথে পাক হায়েনাদের বিকৃত উল্লাসের শব্দ। যখন রক্তের গরম ফিনকি এসে শরীরের উপর পরছিলো তখনই মনে হচ্ছিলো আমাদের একেকজনকে হত্যা করা হচ্ছে। আর পাক সেনারা তখন বলছিলো- ‘সালে লোগ জয় বাংলা বলেগা তো ডিংলা খায়েগা’, ‘বলো গুল্লি খায়েগা না গুল্লি মারেগা’। আমি সবার আগে ছিলাম বলে যাকেই তারা গুলি করেছিল তারাই আমার শরীরের উপর এসে পড়েছিল। ২১ জনের লাশের চাপায় পড়ে যাই আমি, আমার ডান হাতে একটি গুলি লাগে। যা এখনো সে মূহুর্তগুলো জ্বল জ্বল করে মনে করিয়ে দেয়।

কথা বলতে বলতেই কেঁদে ওঠেন নারায়ণ বল্মিক। এই কান্না তার গুলিবিদ্ধ হাতের জন্য না সেদিন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের জন্য তা বুঝা যায় না। কান্নার চাপে ভাষা হারিয়ে ফেলেন এই বৃদ্ধ চা শ্রমিক। আর কিছুই বলা হয়ে উঠে না তার। আর কিছু অবশ্য বলারও নেই। তারপর তো জানা কাহিনী। বঞ্চনা, প্রতারনা, অবজ্ঞা আর রাষ্ট্রীয় প্রহসনের কাহিনী।

সোদিন ২১ জন শহীদ হলেও তাদের ভাগ্যে জোটে নি কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। শহীদের তালিকায় নাম নেই এঁদের। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, স্থানীয় প্রশাসন কেই জানে না এই শহীদদের কথা। চা বাগানে তাদের সহকর্মীরাও ভুলে গেছেন নিজেদের বীর সঙ্গীদের নাম। ২১ শহীদের নাম ভুলে গেছেন প্রায় সবাই।

সরেজমিনে চা বাগানে গিয়ে শহীদ চা শ্রমিকদের আত্মীয় স্বজনদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিমানে অকৃতজ্ঞ এই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন তাঁরা।
কেবল একজনের দেখা পাওয়া যায়। তিনি মানিক লাল হাজাম। একাত্তরের সেই বিভিষিকাময় দিনে বাবা আর ভাইসহ পাঁচজনকে হারিয়েছিলেন চা শ্রমিক মানিক লাল হাজাম। তার বাবা দূর্গাচরণ হাজাম, বড় ভাই মতি লাল হাজাম, মেজো ভাই হীরা লাল হাজাম, বনোয়ারী হাজাম, কাকাতো ভাই দিলীপ হাজার এ পাঁচ জনকে হত্যা করে পাক হায়েনারা।

মানিক লাল হাজাম বলেন, বয়েস অল্প হওয়ায় সেদিন পাক সেনাদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাই আমি। তবে হারাতে হয় আমার পরিবারের সকল পুরুষ সদস্যদের। বাবা-ভাইকে হারিয়ে দুঃখ নেই। তাদের প্রাণের বিনিময়ে দেশ পেয়েছি। কিন্তু দেশ আমাদের কী দিলো? দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তাদের শহীদের মর্যাদাটুকু দেওয়া হয় নি।

এদিন অন্যান্য শহীদরা হলেন- হাড়ো ছত্রী, তৈলা ছত্রী, সুন্দর রবিদাস, চুরু নায়েক, সুরেন্দ্র নায়েক, যুগেস নায়েক, সুরেন্দ্র ছত্রী, রবি বাড়াইক, অনিল খ্রীস্টান, পিরন হাজাম, ছবি ছত্রী, নন্দ কর্মকার, লাল মোহন কর্মকার, রবি বাড়াইক, তিলর হাজাম।

একদিনে পাকসেনাদের হাতে ২১ জন শহীদ হলেও তাদের স্মৃতি সংরক্ষনেও নেওয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ। চা বাগানে যেও একটা স্মৃতিসৌধ সেটার খোঁজ কেউ রাখে না।

এব্যাপারে নারায়ণ বল্মিক দাস বলেন, ২১ লাশ সৎকার করার স্থানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করি। কিন্তু এ স্থানটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য বড় করে একটি ফলকটি নির্মাণ করার জন্য বারবার দাবি জানালেও বাগান কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসন কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না।

জানা যায়, ২০১০ সালে বড় করে স্মৃতিসৌধ নির্মান কাজ শুরু হলেও মাঝপথে তা থেমে যায়। অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য স্মৃতিসৌধ নির্মান কাজ বন্ধ করে টাকা অপসারন করে ফেলেন। তবে এ ব্যপারে খামিনগর ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্যা সুগা রাণী বসাক বলেন, কয়েক বছর আগে স্মৃতিসৌধ নির্মানের জন্য ৫০ হাজা টাকা বরাদ্ধ পেয়েছিলাম। কিন্তু একমাস কাজ করার পর উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, খাদিমনগর চা বাগানে স্মৃতিসৌধ তৈরির জন্য অনেক আগেই বরাদ্ধ দিয়েছিলাম। এখন কী অবস্থায় আছে তা জানি না।

খাদিমনগর বাগানে ২১ শহীদ চা শ্রমিকদের ব্যাপারে সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, খাদিম নগরের স্মৃতিসৌধের ব্যাপারে আমার ধারনা নেই। সেখানে ২১ জনকে পাক সেনারা হত্যা করেছিলো বলে শুনেছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত