সিলেটটুডে ডেস্ক

০১ জানুয়ারি, ২০১৬ ২০:১৭

সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ‘অবহেলার’ কথা বলছেন আদালত

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং আপিল বিভাগের রায়ে সেটা পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের অবহেলায় বিরক্তি প্রকাশ করেছেন আদালত।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাঈদীর মামলার তদন্তকর্মকর্তা ছাড়াও আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তার প্রতিও বিরক্তি প্রকাশ করেন। তদন্তকারীর ত্রুটি দূর করতে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তাও যথাযথ চেষ্টা করেনি বলে মন্তব্য করেন আদালত।

চ্যানেল আই অনলাইন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যায় আসামীপক্ষের হাজির করা নথিতে গরমিলের পরও রাষ্ট্রপক্ষের নিরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ রায়ে। ওই দলিল আসল না ভুয়া সে ব্যাপারেও তারা চুপ ছিলেন মন্তব্য করে আদালত বলেন, “অথচ নথিতে গরমিলের বিষয়টি খালি চোখেই ধরা পড়ে”।

সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সাঈদীর মামলায় রাষ্টপক্ষের আইন কর্মকর্তার নির্বিকার থাকাকে ‘শিক্ষানবিশসুলভ’ আচরণ বলে মন্তব্য করেন আদালত।

‘অপেশাদারি’ আচরণে ক্ষুব্ধ আদালত বলেন,‘ প্রসিকিউশনের হয়ে এ ধরণের মামলা পরিচালনার নূন্যতম জ্ঞানও যার নেই তার এই মামলা পরিচালনার দায়িত্বই নেয়া উচিৎ হয়নি। এর দায়ভার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবীও এড়াতে পারেন না। মামলায় তার নির্দেশনা অপরিহার্য। প্রসিকিউশন টিম শহীদদের রক্ত নিয়ে জুয়া খেলতে পারে না’।

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই ধরণের স্পর্শকাতর একটি মামলায় তাদের এমন আচরণে আদালত মর্মাহত বলেও রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে।

আদালতের মতে, ৬, ১১, ১৪ ও ৮ নম্বর অভিযোগের কিছু অংশসহ মোট ৪টি অভিযোগ প্রমাণে এবং ইব্রাহিম কুট্টি হত্যায় আসামীপক্ষের হাজির করা দলিলপত্র ভুয়া কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টাই করেনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দায়িত্বেও জায়গাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে আগামী প্রজন্মের সামনে দুর্বৃত্তদের মুখোশ খুলে দিতে জনগণের বিপুল টাকায় এই বিচার হচ্ছে’।

তাই এ ধরণের অযোগ্য ব্যক্তিদের তদন্ত ও আইনী লড়াই পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেন আদালত।

আদালত আরও বলেন, ‘বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো মারাত্মক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য মামলায় ত্রুটিরোধ করতে অবশ্যই এই ব্যক্তিদের বাদ দেয়া উচিৎ’।

যে চারটি অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ রাষ্ট্রপক্ষ:
অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল শান্তি কমিটির সদস্য পিরোজপুর সদরের পারেরহাটে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিকে ওই এলাকায় স্বাগত জানান। তাদেরকে পারেরহাট বাজারে নিয়ে এসে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান পাট চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে সাঈদী অন্যান্যদের সঙ্গে এ সকল বাড়ি ও দোকানে হানা দিয়ে মূল্যবান সম্পদ লুট করে। যার মধ্যে সেখানে মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্যও লুট করেন সাঈদী। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সংগঠিত এই সব কার্যক্রম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যার আইনের ৩(২)(এ) ধারায় শাস্তিযোগ্য।

অভিযোগ-১১: ২ জুন সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ইন্দুরকানি থানার টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে সাঈদী তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করে। এরপর সাঈদী নগদ টাকা, অলঙ্কারাদি ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান।

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এক সকারে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী সদর থানার হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে শেফালী ঘরামি ও মধুসুদন ঘরামি ছাড়া বাকিরা সবাই পালিয়ে যায়। তখন রাজাকার বাহিনীর কিছু সদস্য শেফালী ঘরামির ঘরে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। দলনেতা হওয়া সত্ত্বেও সাঈদী এই ধর্ষণে বাধা দেননি। পরে তারা এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দিয়ে দেয়।

অভিযোগ-৮: ৮ মে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সাঙ্গপাঙ্গরা পাক বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহিমকে সহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যান। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। সেনা ক্যাম্পে ফেরার পথে সাঈদীর প্ররোচণায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে লাশ ব্রিজের কাছে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে সাঈদী ও অন্যদের আগুনে পারের হাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাঈদী সরাসরি অপহরণ, খুন, যন্ত্রণাদানের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। যা আইনের ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে অপরাধ।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। সে রায়ে তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দুটি অপরাধে অর্থাৎ ৮ ও ১০ নং অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দুটি আপিল আবেদন করে।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড থেকে দণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।

আপিল মামলার সংক্ষিপ্ত ওই রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ।ওই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি ছিলেন; বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যায় সহযোগিতা, আট নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং একশ’ মতান্তরে একশ’ ৫০ জন হিন্দুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করাসহ ২০টি অভিযোগ ছিলো ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে। সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত