নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ মার্চ, ২০১৬ ০১:২৪

ঘোষণার আগেই ‘বিতর্কে’ যুদ্ধাপরাধী কাসেমের রায়

আপিলের রায় ঘোষণার আগেই বিতর্কের মুখে পড়েছে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রায়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময়ে প্রকাশ্য আদালতে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বে অবহেলাজনিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের দুই মন্ত্রী এ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে রায় নিয়ে বিতর্কের পাশাপাশি ধোঁয়াশাও ঘনীভূত হয়েছে।

বিতর্কের শুরুটা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করার মাধ্যমে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি মীর কাসেম আলীর মামলাসহ অন্যান্য মামলা পরিচালনায় থাকা দায়িত্বশীলদের প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাঈদীর মামলার শুনানির সময়ও এ রকম অসঙ্গতি ধরা পড়েছিলো।’ উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্য আদালতে এমন মন্তব্যের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মীর কাশেমের বিচারে প্রসিকিউশনের গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, গত ৫ মার্চ  রাজধানীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এসব মন্তব্যের মাধ্যমে 'হাফ রায়' দেওয়া হয়ে গেছে। তারা আপিল শুনানি আবারও নেওয়ার দাবি জানান।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে আদালতে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মীর কাশেমের ফাঁসি বহাল থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মীর কাশেমের আর ফাঁসি বহাল রাখার সুযোগ নেই। হয় তাকে খালাস দেওয়া হবে অথবা শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হবে।

তিনি প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বেঞ্চ পুণর্গঠন করে পুনরায় আপিলের শুনানির দাবি জানান।

অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রসিকিউশন নিয়ে এমন মন্তব্যের পর তাঁর আর প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকা অনুচিত।

একই অনুষ্ঠানে শাহরিয়ার কবীর একাত্তরে প্রধান বিচারপতি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এ অভিযোগ উত্থাপন করে শান্তি কমিটির সদস্যদেরও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। ৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুনু এ নোটিশ পাঠিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই মন্ত্রীকে তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে লিগ্যাল নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি একে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহি বিভাগের হস্তক্ষেপ অভিযোগ করে সরকারের সমালোচনা করেছেন।

মন্ত্রীদের বক্তব্যের দিনই সুপ্রিম কোর্ট বার আয়োজিত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি ও মীর কাসেম আলীর রায় নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় অবহেলার অভিযোগ নাকচ করে দিলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম দুই মন্ত্রীর অভিযোগকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করে আশা প্রকাশ করেছেন যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বহাল থাকবে। তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছে।

এদিকে, রায় ঘোষণার আগে আদালতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের অভিযোগ শীর্ষ এ যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর ষড়যন্ত্র চলছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এ রায় নিয়ে যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে প্রয়োজনে আবারও শাহবাগ অবরোধ করে রাখার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে।

মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালীন সময়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের রেশ ধরে দেশব্যাপী নানামুখী আলোচনা ও সরকারের দুই মন্ত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যকে সরকারের মন্তব্য বলে জানিয়েছেন।

সোমবার (৭ মার্চ) মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের নয়। মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্যে তিনি বিব্রত হয়েছেন, তাঁর সরকারও বিব্রত।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৮ মার্চ) যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের আপিলের রায় ঘোষণা করা হবে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করবেন। এ বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর মীর কাসেম আলী আপিল করেন। মীর কাসেম তার দেড়শ’ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ১ হাজার ৭৫০ পৃষ্ঠার আপিলে মোট ১৬৮টি কারণ দেখিয়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন।

আট জনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা এবং সেই সময়ের ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী। তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।

এদিকে মীর কাসেম আলীর মামলাটির মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতে ৭ম আপিল মামলার শুনানি করা হবে। এর আগে ঘোষিত ৬টি আপিল মামলার চূড়ান্ত রায়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকি দুটির মধ্যে একটির পূর্ণাঙ্গ ও অপরটির সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত