হাসান মোরশেদ

০৬ জুলাই, ২০১৫ ১৫:১৫

দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব-৮

সর্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাঁকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে, অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাসপার্টির খোঁজে। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুডে২৪ ডট কম-এ। আজ প্রকাশিত হলো ৮ম পর্ব

[সপ্তম পর্বের পর...] 

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ২৬ তারিখেই তারা জানতে পারেন। পরের দিন কিংবা এর পরের দিন ইউনিয়নের সব কিশোর তরুণদের জরুরী সভা ডাকা হয়। যেহেতু তখন ভৈরব থেকে আজমিরীগঞ্জ, শেরপুর নৌপথ চালু ছিলো এবং কাকেলছেও গ্রাম এই পথেই, এই গ্রাম হিন্দু প্রধান এবং আওয়ামী লীগের ঘাঁটি তাই সহজেই পাকিস্তানীদের টার্গেট হবে। 

জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত নেন তরুণেরা হাওর পাড়ি দিয়ে তারা উত্তরের ভারতীয় সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাবে এবং যুদ্ধ করবে। এই তরুণদের মধ্যে চেয়ারম্যান এর ভাই মিজবাহ উদ্দীন ভুঁইয়াও ছিলেন, কিন্তু পরদিন সকালে রওয়ানা দেবার সময় দেখা গেলো- ইলিয়াস ও তার ভাই বদিউজ্জামান ছাড়া আর কেউই নেই। যদিও পরে এই গ্রামের আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু চেয়ারম্যানের ভাই যিনি বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি আর যাননি যুদ্ধে।

সেই সকালবেলা তারা দুভাই- আঠারো উনিশবছরের তরুণ বেরিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে যাবার জন্য যদিও তারা জানতেন না কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন। এক কাঠ ব্যবসায়ীর নৌকা করে তারা দিরাই আসেন, দিরাই থেকে পরে সুনামগঞ্জ হয়ে বালাট সীমান্তে পৌছেন। বালাট তখন এই অঞ্চলের কয়েক লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয়কেন্দ্র। এপ্রিলের মাঝামাঝি সেই সময়ে চরম দুরবস্থা, কোন নেতৃত্ব নেই, সিদ্ধান্ত নেই, যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুণেরা ভীড় করেছে কিন্তু কোন দিকনির্দেশনা নেই।

এরমধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ কলেরার প্রাদুর্ভাব। একদিকে হাজার হাজার শরণার্থী এসে ভীড় করছে আরেকদিকে শতশত শরণার্থী মরছে প্রতিদিন কলেরায়। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এবং বিরোধীদলের একমাত্র নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও উপস্থিত এখানে কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরও নিয়ন্ত্রণে না।

এই বিপদের মধ্যে আরেক উপদ্রব খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ভারতিয় সীমান্তের ভেতর মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে বালাট। এগুলো খাসিয়াদের জায়গা, রাজনৈতিক কারণে এরা ইন্দিরা গান্ধীবিরোধী। শরণার্থী হিসেবে কয়েক লাখ বাঙালি এদের চক্ষুশুল। প্রায়ই এসে তারা হুমকি-ধামকি মারামারি করে। অসহায় শরণার্থীদের কাছ থেকে মদ খাওয়ার জন্য টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

শরণার্থী হিসাবে আসা এক তরুণ এর প্রতিবাদ করে। সে আরো কয়েকজন তরুণকে নিয়ে একটা দল গঠন করে। খাসিয়ারা শিবিরে আক্রমণ করলে এরা পালটা আক্রমণ করে কয়েকজনকে ধরে ফেলে এবং পাহাড়ি নদীর চরে এনে চরম শাস্তি দেয়। এই ঘটনার পর আর কোনদিন খাসিয়াদের পক্ষ থেকে বাঙালি শরণার্থীদের ভোগান্তি হয়নি।

প্রতিবাদী সেই তরুণটি ইলিয়াসের চেয়ে বয়সে দুতিন বছরের বড়, আগের পরিচয় ছিলোনা যদি ও একই এলাকার। এই তরুণটি জগতজ্যোতি দাস। একই থানা আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে বাড়ি। জলসুখা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর দুবছর আসামে পড়ালেখা করে বাড়ি ফিরে স্কুলে শিক্ষকতাও করেছে। এরপরে চলে এসেছে সুনামগঞ্জ কলেজে ডিগ্রী পড়তে, ইংলিশ ও হিন্দী ভাষায় তার অনবদ্য দক্ষতা। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত। বন্ধুদের কাছে দুর্দান্ত সাহসী বলে পরিচিত। ২৭ মার্চের সুনামগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে এবং ট্রেজারী ভেঙ্গে রাইফেল লুট করে নিয়েছে।

সহজাত নেতৃত্বগুণে জগতজ্যোতি দাস যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুণদের নেতা হয়ে উঠেন শরণার্থী শিবিরেই আর আঠারো/ উনিশ বছরের ইলিয়াসও হয়ে উঠেন দাদার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন, পরবর্তীতে যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি পরিচিতি পান ‘দাসবাবুর ছোটভাই’ হিসেবে। এপ্রিল-মে দু মাস এভাবেই যায়, যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুণরা ক্রমশঃ অধৈর্য্য হয়ে উঠতে থাকে। বালাট ক্যাম্পের তত্বাবধানে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, হোসেন বখত, আব্দুজ জহুর এবং ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপর তারা চাপ তৈরী করতে থাকে। বয়সে তরুণ থাকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথেই এদের যোগাযোগ ছিলো ভালো। এ ছাড়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব ও মুলতঃ সুরঞ্জিতই পালন করতেন।

শেষ পর্যন্ত ১১৪ জন তরুণের প্রথম দলটি বালাট থেকে যাত্রা শুরু করে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ইকো-১ এ।

নিশ্চয় এ এক অবিস্মরণীয় মুহুর্ত ছিলো। মুলত পনেরো থেকে পঁচিশের বয়সের সকলে, আরেকটু বেশি বয়সের ও কেউ কেউ ছিলেন হয়তো- এরা কেউ এসেছে সুনামগঞ্জ থেকে, কেউ হবিগঞ্জ এর ভাটি অঞ্চল থেকে, কেউ কিশোরগঞ্জের হাওর থেকে, নেত্রকোনার পাহাড় অঞ্চল থেকেও হয়তো কেউ। এদের কারো স্বজন নিহত হয়েছে- ধর্ষিত হয়েছে, কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ পরিবারের সদস্য নিয়ে, কেউ বা শুধু একাই চলে এসেছে আরেক দেশের এই শরণার্থী শিবিরে- প্রথমত প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজনে, এরপর প্রতিশোধের স্পৃহায়। এরা কেউ ছাত্র, কেউ কৃষিজীবি, কেউ হাওর নদীর জেলে, কেউ রাজনৈতিক কর্মী- প্রশিক্ষণ যাত্রার শুরু থেকে এরা সবাই আরেক অনন্য পরিচয়ের অধিকারী- এরা একটা দেশের মানূষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে, এরা একটা মানবিক ইতিহাসের অতি গুরত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যাচ্ছে।

বালাট থেকে চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং এর দিকে যেতে প্রশিক্ষণার্থী যোদ্ধাদের বহনকারী একটি গাড়ী খাদে পড়ে কয়েকজন আহত হয়। বাকীরা শিলং গিয়ে রাত্রিযাপন করে, শিলং থেকে পরদিন ইকো- ১ ট্রেনিং ক্যাম্প। ইকো-১ ছিলো মেঘালয় এর জৈন্তিয়া হিলস এর জোয়াই শহরের কাছাকাছি কোথাও।

৩২ দিনের নিবিড় প্রশিক্ষণ চলে ওখানে। এর মধ্যে বাছাই করা কয়েকজনকে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ব্রীজ ও স্থাপনা ধ্বংস, জাহাজ ও নৌ পথ যুদ্ধের। ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে পুরো দলকে তিনটা গ্রুপে ভাগ করা হয়, একটা গ্রুপ পাঠানো হয় ডাউকি/ তামাবিল সাব-সেক্টরে, একটা গ্রুপ বালাট সাব-সেক্টরে আর আরেকটা গ্রুপ সদ্য গঠিত টেকেরঘাট/ বড়ছড়া সাব-সেক্টরে। পশ্চিম খাসিয়া হিলস এর নীচে, টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ে টেকেরঘাট ছিলো লাইমস্টোন কারখানা। মাঝখানে হাওর, চার/ পাঁচ মাইল দক্ষিণে থানা সদর তাহিরপুর পাকিস্তান আর্মির দখলে।

অবকাঠামো ও অবস্থানগত বিবেচনায় সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এখানেই গড়ে উঠে ৫ নং সেক্টরের সবচেয়ে উত্তর পশ্চিমের সাব-সেক্টরটি। প্রথম দিকে কোন আর্মিম্যান না থাকলেও পরে মেজর মুসলিম উদ্দীণ সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এখানে। কিছু আনসার- ইপিআর এবং অতি সামান্য সামরিক সদস্য ছাড়া এই সাব-সেক্টরের পনেরোশ’ গেরিলার প্রায় সকলেই ছিলেন বেসামরিক। সামরিক-বেসামরিক সংখ্যার অনুপাতে, ধারণা করি সারা দেশের মধ্যে এই সাব-সেক্টরেই গণযোদ্ধারা সবথেকে বেশি ছিলেন।

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩৬ জন বিশেষ প্রশিক্ষিত গেরিলা জোয়াই- শিলং-চেরাপুঞ্জি- বালাট হয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে সংযুক্ত হন। তাদের সামরিক পরামর্শক ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর ভাট ও ক্যাপ্টেন ভার্মা। আর গেরিলা দলটির কমান্ডার জগতজ্যোতি দাস। তার নামেই দলটির দাপ্তরিক নাম ‘দাস পার্টি’। টু-আইসি ধর্মপাশার আলী আমজদ। গোটা ভাটি অঞ্চল মুক্ত করার যুদ্ধে অন্যান্য গ্রুপের সাথে থাকার পাশাপাশি এদের বিশেষ দায়িত্ব ভৈরব-আজিমিরীগঞ্জ-শেরপুর নদীপথ পাকিস্তান আর্মির জন্য বিপদসংকুল করে তোলা।


[দাসপার্টির যুদ্ধসীমানা]

[ভৈরব- আজিমিরী-শেরপুর নদীপথ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককের বেশির ভাগ সেতু ও ফেরী গেরিলা আক্রমণে পর্যুদস্ত হলে এই নদীপথ হয়ে উঠে পাকিস্তান আর্মির রসদ ও অস্ত্র সরবরাহের লাইফ লাইন। দাসপার্টির একের পর এক অপারেশনে, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পাকিস্তান রেডিওতে এই পথ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়]

হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং, বানিয়াচং থেকে হাওর নদী পাড়ি দিয়ে আমরা যখন আজমিরীগঞ্জ নামি পূব আকাশে তখন সরু চাঁদ আর সন্ধ্যাতারা, টমটম নিয়ে কাকেলছৈও পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ জুড়ে লক্ষ তারার হীরে; একজন আঠার বছরের গেরিলা এখন একষট্টি বছরের প্রৌঢ়- তাদের যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতির গল্প শুনতে শুনতে আকাশ পানে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যাতারা শুকতারা হয়ে গেছে, সরু চাঁদ অনেকটাই পশ্চিমে। আজকে প্রথম রোজা, সেহরির সময় প্রায় হয়ে গেছে।

কাল সকাল বেলা আমরা বের হবো যুদ্ধক্ষেত্রগুলো দেখতে ।

সেহরির জন্য নেমে আসি আমরা তারাজ্বলা আকাশের নীচ থেকে।

 

আগের সকল পর্বের লিংক-  

[প্রথম পর্ব]  [দ্বিতীয় পর্ব]  [তৃতীয় পর্ব] [চতুর্থ পর্ব] [পঞ্চম পর্ব]
  [ষষ্ঠ পর্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত