সিলেটটুডে ডেস্ক

১৫ জুন, ২০২০ ০০:৪০

‘লিভিং ইগলস’ সাইফুল আজমের মৃত্যু

পৃথিবীর ২২ জন ‘লিভিং ইগলসের’ অন্যতম, সাবেক সংসদ সদস্য ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) সাইফুল আজম আর নেই। রোববার দুপুর দেড়টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

সাইফুল আজম বাংলাদেশ, পাকিস্তান, জর্ডান ও ইরাকের বিমানবাহিনীর বৈমানিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বৈমানিক হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী তাকে বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’ এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’ এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ।

সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে পাবনা জেলায়। বাবার কর্মসূত্রে তার শৈশবের কিছু সময় কেটেছিল কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তার পরিবার ফিরে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। শিক্ষালাভের জন্য ১৪ বছর বয়সে সাইফুল আজমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু’ বছর পর ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ওই বছরই জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সাইফুল আজম যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে।

সাইফুল আজমের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষণ বিমান ‘সেসনা টি-৩৭’ বিমান দিয়ে। এরপর তিনি প্রশিক্ষণ নিতে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার লুক এয়ারফোর্স বেইসে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আজম যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ঢাকার কেন্দ্রে। পরে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান করাচির মৌরিপুরের বিমান ঘাঁটিতে। এখানেই সাইফুল আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক।
১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে যোগ দেন। এই যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এ ভূষিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্ডানের বিমানবাহিনী ‘রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্স’-এ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। সেখানে তিনি জর্ডানের বিমানবাহিনীতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

বিজ্ঞাপন

একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডটিও তার। এই কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ জর্ডান থেকে সাইফুল আজমকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গি বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন সাইফুল আজম। এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ‘ফাইটার লিডারস স্কুল’ এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি।

১৯৭১ সালে সাইফুল আজম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের শুরুতেই তার ওপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে সাময়িকভাবে উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। করাচির মশরুর ঘাটি থেকে বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। তার ওপর চলে পাকিস্তানিদের অত্যাচার। পাকিস্তানি সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তাকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চাপে সে মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়িত হয়নি। 

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন সাইফুল আজম। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। তাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক করা হয়। বিমানবাহিনীতে ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনসের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন তিনি।

অবসরের পর সাইফুল আজম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

১৯৯১-৯৬ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুল আজম। এরপর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত