২৮ অক্টোবর, ২০২৫ ০৮:১৯
গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী (৬০) অপহরণ ইস্যুতে পুরো দেশজুড়েই তোলপাড় হয়েছে। ইসকন তাকে অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ করে ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভও হয়েছে।
তবে তিনি অপহরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন, যে এলাকা থেকে যখন তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন, সেই সময়ের সেই এলাকার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে অপহরণের বর্ণনার সাথে ফুটেজের মিল পায়নি পুলিশ।
মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী সামাজিক মাধ্যমে মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মাদানী নামে বেশি পরিচিত।
তিনি দাবি করেছেন, তাকে গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভার্সন সেন্টারের সামনে থেকে অপহরণ করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। পরদিন পঞ্চগড়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধারের কথা নিজেই সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন।
গোটা একটি দিন নির্যাতন, কথিত অপহরণের আগে একের পর এক উড়ো চিঠি পাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
তবে মঙ্গলবার সকালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ওই এলাকার সে সময়ের কিছুিসিসিটিভি ফুটেজ জুড়ে দিয়ে দাবি করেছেন মুফতি মুহিবুল্লাহ অপহৃত হননি।
ফেসবুকে ‘সকল সিসিটিভি ফুটেজ সংযুক্ত ভিডিওটি দেখুন — নিজ জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনার সঠিক প্রয়োগ করে ঘটনার উদ্দেশ্য বুঝে নিন-’ শিরোনামে এক পোস্টে সায়ের লিখেন- ‘গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেছিলেন গত ২২ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ৭টার দিকে টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ডকনভার্সন সেন্টারের সামনে থেকে তাকে অপহরণ করে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়।
তবে উক্ত এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সকাল ৬টা ৫২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে তিনি ঘর থেকে বের হন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বাম হাতে দরজা খুলে বের হন, পেছন ফিরে তাকাননি এবং টিনের দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।’
‘সকাল ৬টা ৫৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে তিনি মসজিদ ছাড়েন এবং প্রায় ৬টা ৫৪ মিনিটে টঙ্গী টু কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কে কালীগঞ্জের দিকে রওনা হন। পরনে ছিল সাদাপাঞ্জাবি-পাজামা, মাথায় কালো রঙের পাগড়ি।
মুহিব্বুল্লাহর বাসার অদূরে শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন সেন্টারের চারটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও এজাহারে উল্লেখিত অপহরণের বর্ণনার মিল পাওয়া যায়নি।’
সায়ের আরও লিখেন, ‘বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে নেওয়া চারটি ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে মুহিব্বুল্লাহ পাম্পের সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স পথরোধ করে তাকে অপহরণের যে দাবিটি করা হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে এরকম কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। বরং তাকে একাই দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।’
‘সামনের সেতুর উপরে পুলিশের স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় মুহিব্বুল্লাহ একাই হাঁটছেন। অথচ এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ফিলিং স্টেশনের সামনে তাকে অপহরণ করাহয়।’
‘৬টা ৫৪ মিনিটে এলাকা থেকে রওনা হয়ে তিনি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ফিলিং স্টেশনে পৌঁছান সকাল ৭টা ১৮মিনিটে।
সায়ের ওই পোেস্টে জানান, ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. সোলেইমান নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের জানান 'তিন দফায় পুলিশের বিভিন্ন শাখা আমাদের সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ করে, আমাদের ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে হুজুরকে অপহরণ করা হয়নি'।
এদিকে, এ ঘটনার তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম দেশকাল নিউজ জানিয়েছে, এখন মুহিব্বুল্লাহই তদন্তের মুখে আছেন।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “এটি খুবই স্পর্শকাতর ঘটনা। সব দিক বিবেচনা করে তদন্ত চলছে। শেষ করে বিস্তারিত আমরা সংবাদ সম্মেলন করেই জানাব।”
অভিযোগ আর সিসিটিভি ফুটেজ ও বক্তব্যে ধারাবাহিকতার অভাবের বিষয়টি সামনে আসার পর মুহিব্বুল্লাহকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। এরপর তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
যেভাবে অপহরণের দাবি
মুহিব্বুল্লাহর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী সদর থানার আউলিয়াপুর গ্রামে। পরিবার নিয়ে বসবাস করেন টঙ্গীর মরকুন টিঅ্যান্ডটি কলোনির মসজিদের কোয়ার্টারে।
তার দাবি, গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে টঙ্গীতে তার বাসার অদূরে শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভার্সন সেন্টারের সামনে টঙ্গী টু কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কের ওপর একটি অ্যাম্বুলেন্স তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই তাকে তুলে নেওয়া হয়।
পরদিন পঞ্চগড় থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে জানিয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমকে তার অপহরণের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য আসার পর দেশে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
পঞ্চগড়ের সাংবাদিকদেরকে মুহিব্বুল্লাহ জানান, ২৩ অক্টোবর সকালে জেলার সদর থানার হেলিপ্যাড বাজার এলাকার রাস্তার পাশে গাছের সঙ্গে হাত-পা শিকলে বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধারের পর তিনি পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে গণমাধ্যমকর্মীকে বলেন, “বুধবার (২২ অক্টোবর) সকাল ৭টার দিকে বাসা থেকে হাঁটতে বের হই। কিছুক্ষণ পর একটি অ্যাম্বুলেন্স সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে চার-পাঁচজন নেমে আমার মুখে কী যেন ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। এরপর কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে।”
যারা তুলে নিয়েছে তাদেরকে বাংলাদেশি নাগরিক মনে হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “তারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিল।”
গত ১১ মাস ধরে বেনামি চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও করেন মুহিব্বুল্লাহ। দাবি করেন, এসব চিঠিতে অখণ্ড ভারত ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংগঠন ইসকনের পক্ষে কথা বলতে বলা হয়। সেই সঙ্গে দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো ও বিএনপি-এনসিপির বিরুদ্ধে কথা বলতে বলা হয়।
সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবরের চিঠিতে কোরআন, ইসলাম, আল্লাহ শব্দ বলতে নিষেধ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
এজাহারে কী লেখা
গত ২৪ অক্টোবর টঙ্গী পূর্ব থানায় উপস্থিত হয়ে অপহরণের মামলা করেন মুহিব্বুল্লাহ। এতে তিনি লেখেন, খতিবের দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিতভাবে বেনামি চিঠির মাধ্যমে হুমকি পেয়ে আসছেন। বেনামি বললেও চিঠির প্রেরক হিসেবে ‘ইসকন সন্ত্রাসী’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি।
এজাহারের ভাষ্য, “চিঠিতে উল্লেখ আছে— আমি যেন অখণ্ড ভারত মাতার পক্ষে কথা বলি, ইসকনের কারাবন্দি নেতা চিন্ময় দাসের মুক্তির ব্যাপারে কৌশলে কথা বলি, এনসিপি, বিএনপিসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে খুতবায় কথা বলি, হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে মুসলিম মেয়ের প্রেমে বাধা নেই বলে ফতোয়া দিই।”
মুহিব্বুল্লাহ আরও লেখেন, তাকে চিঠিতে বলা হয়েছে, “মসজিদে কোরআন পড়া যাবে না, মসজিদে ইসলাম, আল্লাহ ও মুহাম্মদ (স.) নিয়ে কথা বলা যাবে না।”
তাদের কথামতো না চললে তাকে, মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষকে হত্যা এবং তাদের স্ত্রী, কন্যাদের ধর্ষণ করাসহ নানা ধরনের ক্ষতি করার হুমকিও চিঠিতে দেওয়ার অভিযোগ আনেন এই খতিব।
এরই ধারাবাহিকতায় ২২ অক্টোবর সকাল ৭টার সময় প্রাতঃভ্রমণে বের হলে বাসার অদূরে শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভার্সন সেন্টারের সামনে টঙ্গী টু কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কের ওপর একটি অ্যাম্বুলেন্স তার পথরোধ করে দাঁড়ায় বলেও এজাহারে লেখেন মুহিব্বুল্লাহ।
মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেছেন, তাকে এই শেকলে বাঁধা হয়েছিল।
“এবং আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করতে অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন ব্যক্তি জোরপূর্বক অ্যাম্বুলেন্সে তোলে এবং সঙ্গে সঙ্গে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করতে থাকে এবং গাড়ি বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে।”
থেমে থেমে শারীরিক নির্যাতন এবং টানা প্রায় একদিন একরাত গাড়ি চলার পর গাড়ি থামিয়ে প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে কাচের বোতল দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারাত্মকভাবে আঘাত করে দাড়ি কেটে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করা হয় এজাহারে।
“একপর্যায়ে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অজ্ঞাত স্থানে অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন আমাকে বিবস্ত্র করে। দিনের আলো ফুটতে থাকলে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে শিকল দিয়ে বাম পা রাস্তার পাশে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে চলে যায় এবং আমার সঙ্গে থাকা একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।
“পরবর্তীতে রাস্তায় চলাচল করা কিছু লোক এসে আমাকে উদ্ধার করে এবং পরবর্তীতে জানতে পারি যে, এটি পঞ্চগড়। স্থানীয়রা জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ ফোন করলে পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশের সহায়তায় আমি পঞ্চগড় থেকে বর্তমান ঠিকানার বাসায় আসি।”
টঙ্গীতে ফিরে এসে এলাকাবাসীকে যা বললেন
গত শুক্রবার টঙ্গী ফিরেই সেখানকার জনসাধারণ ও মুসলমানদের সামনে বক্তব্য রাখেন মুহিব্বুল্লাহ। অন্যদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি নিজের অপহরণ হওয়া এবং অপহরণের পর কী ধরনের নির্যাতন করা হয় সেই বর্ণনাও দেন। সেখানে উপস্থিত মুসল্লি ও জনসাধারণের অনেকেই তার বক্তব্য শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, “আমি অনেক ক্লান্ত, পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন আমাকে অনেকগুলো পেইনকিলার দিয়েছে। কী বলতেছি ঠিক নাই, আপনারা বুঝে নেন। খতিব সাহেবদের বলতে চাই, সর্বস্তরের দ্বীনের খিদমতে যারা আছেন, তারা সবাই সতর্ক থাকবেন। কখন কী হয়ে যায়, জোয়ারের কাছে থেকে কৃষক যে রকম সতর্ক থাকে সেরকম সতর্ক থাকতে হবে।”
কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ইসলাম নিয়ে যে যতটুকু খিদমত করে তাকে আমি ভালোবাসি। সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, ব্যভিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। আমাকে অত্যাচার করা হলেও আমার এই কণ্ঠ, মুহিব্বুল্লাহ কণ্ঠ স্তব্ধ করা যাবে না।”
পঞ্চগড় থেকে টঙ্গীতে ফিরে মুসল্লিদের উদ্দেশে মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী বক্তব্য রাখেন। তার আবেগঘন বক্তব্য শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন এক মুসল্লি।
এজাহারে উল্লেখ করা চিঠিতে কী লেখা, তাও সাধারণের কাছে তুলে ধরেন মুহিব্বুল্লাহ। তিনি বলেন, “এক নম্বরের আদেশ হলো—অখণ্ড ভারত মাতার পক্ষে কথা বলতে হবে। পূর্ববঙ্গে, বাংলাদেশ বলে স্বীকারই করে নাই, পূর্ববঙ্গে ভারত ছাড়া আপন কেউ নেই।
“দুই নম্বরে, ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণ মহাপ্রভুর জামিনের ব্যাপারে কৌশলে কথা বলবি। বলবি, তাকে আটকে রাখা ঠিক হবে না। কৌশলে এদের পক্ষে কথা বলবি, তাকে আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না।
“তিন নম্বরে বলবি, বাংলাদেশের সকল ধর্মভিত্তিক দল, বিএনপি, এনসিপি এদের বিরুদ্ধে কথা বলবি। এনসিপি পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় শত্রু।
“চার নম্বরে, মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে কোনো বাঁধা নেই। এটা মিম্বারে তুই মাসলা দিবি। এর পরে লিখছে, ‘তোদের বাতুল মোকাব্বরামকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।’ ”
তাদের কথামতো চললে সেক্রেটারি, ক্যাশিয়ার প্রত্যেককে এক কোটি রুপি দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন মুহিব্বুল্লাহ।
চিঠির এই ভাষা কী ইঙ্গিত বহন করে— সেই প্রশ্ন শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে মুহিব্বুল্লাহ বলেন, “ভাষা দেখেন, আধিকারিক—কোন দেশের ভাষা বুঝে নেন। আমাদের দেশে কর্মকর্তা এসব ভাষা লেখে? ওসব দেশে লেখে আধিকারিক।”
দুটি চিঠিতে কী লেখা
মুহিব্বুল্লাহ যেসব চিঠির কথা বলেছেন, তার দুটি পেয়েছে দেশকাল নিউজ ডটকম। এরমধ্যে শেষটি গত ২১ অক্টোবর দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. সাইফুল্লাহ। যদিও সেই চিঠিতে কোনো তারিখ লেখা নেই।
চিঠিতে লেখা, “পূর্ব বঙ্গ, গাজীপুর, টংগী বিটিসিএল মসজিদের আধিকারিক সহিদ, রশিদ তোদের খতিব যে দেবতার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। তাই না? সে এতগুলো চরম পত্রের মূল্য না দিয়ে, নিজের মৃত্যু ডেকে আনলো। তবে জেনে রাখ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আমাদের মোটেই হাত কাঁপবে না। কারণ, আমাদের হাত পাকা হয়ে গেছে। তবে, বুঝা উচিত ছিল, যে আমাদের কান্ট্রি সব মোল্লা এবং মৌলবাদীদেরকে কোটি রুপী সাহায্য করেনা। মসজিদের লোকসমাগম প্রসিদ্ধি খতিবের নেতৃত্বের গুণাবলি বয়সের কারণে অন্য মোল্লা মান্য করার সম্ভাবনা এরকম ২০ টি ক্রাইটেরিয়া সুচকে যে মোল্লারা এগিয়ে থাকে তাদেরকে আমরা সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে কোটি রূপী সাহায্য করে থাকি তাদের বাধ্যক্য জীবন একটু শান্তি দেয়ার জন্য।
“কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, বহু মোল্লা এ মূল্যবান অফার গ্রহণ করে স্বচ্ছল হলেও তোদের খতিব মেহেবুলার (মুহিব্বুল্লাহ) মতো সারমেয়রাই কেবল এ অফারে সাড়া দেয়না, অবশ্য জীবন দিয়ে যে তারে এর মূল্যও চুকাতে হবে।”
‘তোদের খতিব শেষ’ উল্লেখ করে এতে আরও লেখা, “ওর উপর শনি দেবতার রোষানল পরেছে। তোরা তোদের খতিবকে আগের আদেশের সাথে নিচের আদেশগুলো পালন করতে বল-
“৫। মসজিদে করান (কোরআন) পাঠ বন্ধ করতে বল।
৬। মসজিদে আল্লা (আল্লাহ), মুহম্মদ এবং ইসলাম শব্দগুলো উচ্চারণ বন্ধ করতে বল।
৭। বাংলাদেশ নামক জারজ রাষ্ট্রের নাম কোনো বাঙ্গালি যেন মুখে না নেয়। পূর্ব বঙ্গ বলতে হবে।”
(১ থেকে ৪ পর্যন্ত আরও চারটি আদেশের কথা বলা আছে আগের একটি চিঠিতে।)
খতিবকে এক কোটি রূপি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি সেটি না নিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছেন বলেও উল্লেখ করা হয় এতে।
চিঠির শেষে একটি তরবারির ছবি আঁকা ছিল।
মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেছেন, তাকে হুমকি দিয়ে ১০টিরও বেশি চিঠি পাঠানো হয়। এর একটি এটি।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখ লেখা অপর চিঠিতে লেখা হয়, খতিবকে ১০ টি চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো মূল্য দেননি।
তাকে ভাবতে ২০ মাস সময় দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এতে লেখা হয়, “এটা ফাইনাল চরমপত্র। এবার তোদের খতিবকে বলে দে যে-
“১। সে যেন শুক্রবারে মসজিদে অখন্ড ভারত মাতার পক্ষে কৌশলে কথা বলে। কারণ, ভারতবর্ষ ছাড়া পূর্ব বঙ্গের আপনকেউ নাই।
“২। সে যেন ইশকনের কার্যক্রম এবং চিন্ময়কৃষ্ণ মহাপ্রভুর জামিনের পক্ষে কৌশলে কথা বলে। বলে যে, তাকে আটক রাখা ঠিক হচ্ছেনা।
“৩। সে যেন প্রোটেক্ট আওয়ার সিস্টার্স বিডি এর বিপক্ষে কৌশলে কথা বলে এবং বলে মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ছেলেদের সাথে প্রেমে বাধা নেই।
“৪। সে যেন পূর্ব বঙ্গের সব ধর্মভিত্তিক দল এনসিপি এবং বিএনপির বিরুদ্ধে কৌশলে জনমত গঠন করে। বিশেষ করে এনসিপি পূর্ব বঙ্গের প্রধান শত্রু।”
সবাইকে হাজার কিলোমিটার দুর থেকে মনিটরিং করার কথা জানিয়ে লেখা হয়, খতিবকে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। শেষ অবধি তাকে সম্পূর্ণ একা বানিয়ে রাস্তার পাগল বানানো হবে।
“আজ হোক কাল হোক পূর্ব বঙ্গকে ইসলামী মৌলবাদী মুক্ত করা হবে”, লেখা হয় চিঠিতে।
এই চিঠির শেষে হাতে আঁকা একটি ছবি আঁকা ছিল। যেখানে মাথায় চাঁদ তারা চিহ্নিত টুপি ও মুখে দাড়ি সাদৃশ্য একটি লোকের গলায় তরবারি ধরা।
আসামি হবেন মুহিব্বুল্লাহ নিজেই?
গাজীপুর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বলেন, “মুহিব্বুল্লাহ নিজেই নিজের পায়ের সঙ্গে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন। সেসব কিছু নিজে করেছে। তাকে পঞ্চগড় কেউ নেয় নাই। সে নিজের মামলায় নিজেই আসামি হবে। মুহিব্বুল্লাহ নিজেকে অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন।”
যে ধারায় তিনি মামলা করেছেন, এই ধারায় তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমাদের কাছে তার সব ভিডিও আছে। তার নিজের বলা ভিডিও আছে। সে বলেছে, তারা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলেছে। ইন্ডিয়ান মনে হয়েছে। তাকে চোখ বাঁধছে, বোতলে পানি ভরে পিটাইছে।”
মুহিব্বুবুল্লাহ যে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে শরীরে দাগ থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “কিন্তু তার শরীরে কোনো দাগ নাই। তিনি দেখিয়েছেন, তার কেনি থেকে একটু দাঁড়ি কেটেছে। আপনার যদি কারো ওপর রাগ হয় বা আপনি কাউকে যদি অপহরণ করেন তাহলে তার সবটুকু দাঁড়ি কেটে ফেলবেন।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তাও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “শুরুতে তিনি (মুহিব্বুল্লাহ) যেখান থেকে অপহরণ হওয়ার কথা বলেছেন, তিনি সেখান থেকে অপহরণ হন নাই। তাকে দীর্ঘ পথে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। এবং দীর্ঘ পথ হেঁটে সিসিটিভি ক্যামেরার আড়াল হয়ে নিজেই যানবাহনে উঠে চলে গেছেন।
“তিনি কোন যানবাহনে প্রথমে উঠে গেছেন সেটা দেখা যায় নাই। ব্রিজের উপরের সিসিটিভি ক্যামেরায় যতদূর দেখা যায় তাকে, তিনি হাঁটতেই আছেন। তাকে কেউ অ্যাম্বুলেন্সে তোলেনি।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুহিব্বুল্লাহর মোবাইল ফোন ট্রাকিং করে জানতে পেরেছে, তিনি প্রথমে সিরাজগঞ্জ ও পরে সেখান থেকে পঞ্চগড় যান।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সাদা পোশাকে মুহিবুল্লাহকে নজরদারিতে রেখেছেন। তিনি যে কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন বলেও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সূত্র: দেশকাল নিউজ ও সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের
আপনার মন্তব্য