২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ২১:০২
সিলেটের মেয়ে অনিকা তাহসিন চৌধুরী। মাইক্রোসফট আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন অফিসে ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
অনিকা সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক শেষ করে পেশাগত জীবন শুরু করেন স্যামসাং-এ। তারপর পাড়ি জমান আয়ারল্যান্ডে। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কেমন করে যোগ দিলেন মাইক্রোসফটে।
২০২২ সালে ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডে পাড়ি জমান অনিকা। তখন মাইক্রোসফটে লেঅফ চলার কারণে হায়ারিং বন্ধ চলছিল। তখন ছয় মাসের মধ্যে উপযুক্ত চাকরি খুঁজে বের করার টার্গেট ছিল। তবে বছরখানেকের মধ্যে কোনো চাকরির সুরাহা হয়নি। তিনি নন-ইউরোপিয়ান। পাশাপাশি ভিসার স্ট্যাটাসও তলানিতে। সব মিলিয়ে শুরুতে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমদিকে মাইক্রোসফটে অ্যাপ্লাই শুরু করেন। তখন তিনি গুগলের হাজবেন্টের রেফারেল নিয়ে অ্যাপ্লাই করেন। মার্চ মাসে এক প্রতিষ্ঠান থেকে রিজেকশন মেইল আসে। মজার বিষয় হলো, সেদিন রিক্রুটার একই পজেশনের জন্য মাইক্রোসফট থেকে যোগাযোগ করেন। অনিকা একবাক্যে ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজি হয়ে যান। রিক্রুটার তাঁকে দ্রুত অ্যাসেসমেন্টগুলো দিতে বলেন। এরপর দিনক্ষণ ঠিক করে প্রথম ইন্টারভিউতে বসেন।
ইন্টারভিউর আধা ঘণ্টা পর রিক্রুটার জানান, ‘তুমি এই অ্যাসেসমেন্ট পাস করেছ, পরবর্তী ইন্টারভিউয়ের জন্য তারিখ ঠিক কর।’ তখন অনসাইট ইন্টারভিউয়ের তারিখ ঠিক করেন। অনসাইটের মধ্যে কোডিং, অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং এবং সিস্টেম ডিজাইন–তিনটি রাউন্ড হয়। তাঁর ইন্টারভিউ ভালোই হয়েছিল। তিন-চার দিনের মধ্যে রেজাল্ট জানানোর কথা ছিল। এরমধ্যে কোনো খবর না আসায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সাত-আট দিন পর রিক্রুটার কল দেন।
তিনি জানান, হায়ারিং ম্যানেজারের সঙ্গে বিহেভিওয়ারাল ইন্টারভিউতে বসতে হবে। এটিই ছিল তাঁর ফাইনাল ইন্টারভিউ। দিন পাঁচেক পর রিক্রুটার জানান, ‘আই ডিড ওয়েল ইন দ্য ইন্টারভিউ...।’ ক’দিন পরেই মাইক্রোসফট থেকে অফার লেটার পান। বিষয়টি অনিকার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল! এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁর মনো হলো, দীর্ঘ দিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন।
মাইক্রোসফটে অনিকা যা করেন
অনিকার মাইক্রোসফটে পথচলা এখন এক বছরের বেশি সময়ের। এখানে খুব দক্ষ লোকজন চাকরি করেন। অনিকা বলেন, ‘তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। প্রথমদিকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে টিমের সবার সাপোর্ট পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। তাছাড়া সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারদের থেকে সহযোগিতা পাই। তাদের গাইডেন্স, ডিরেকশন ও সাপোর্ট পেয়ে আত্মবিশ্বাসের মাত্রায় ভাটা পড়েনি। এক বছরে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শিখেছি। বড় স্কিলে কীভাবে একটা প্রোডাক্ট রান করা যায়, এই বিষয়গুলো রপ্ত করেছি। সিস্টেম ডিজাইন, প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং ফিচার ডিজাইন–এই বিষয়গুলোতে পরিপক্ব হয়েছি। প্রোডাক্টের উন্নতি করতে হলে কী করতে হয়, প্রোডাক্টগুলো কাস্টমারদের কাছে যায়। তাদের কথা চিন্তা করে প্রোডাক্ট তৈরি করতে হয়। আমি ৩০ জনের টিমে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছি। কনজিউমারদের জন্য তাদের সার্ভিস কাজ করে থাকে। বর্তমানে আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ফোকাসনির্ভর কাজ করছি।’
সুযোগ-সুবিধা
মাইক্রোসফটে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনিকা বলেন, ‘মাইক্রোসফটে চাকরিতে বেসিক স্যালারির সঙ্গে স্টক বোনাস দেওয়া হয়। বছরে ২৫ দিন ছুটি রয়েছে। মেয়েদের গর্ভকালীন ছুটি বা মেন্টাল হেলথের জন্য ভালো একটা সাপোর্ট দেয়। হেলথ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে লাইফ ইন্স্যুরেন্সও দিয়ে থাকে। মেন্টাল হেলথের জন্য মাইক্রোসফটে জিম, খেলাধুলা, হ্যাকাথনের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিভা প্রমাণের সুযোগ আছে। এছাড়া এখানে কাজের ভালো পরিবেশ রয়েছে।’
স্বপ্ন দেখার শুরুর কথা
এক যুগ আগের কথা, অনিকা পত্রিকা পড়ছিলেন। পাতা ওল্টাতেই গুগলে এক আপুর চাকরির খবর চোখে পড়ে। সে সময় প্রায়ই বড় আপুদের এমআইটি-হার্ভার্ডে উচ্চশিক্ষার সংবাদ দেখতেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়দের আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরির খবর শুনতেন। তাদের দেখে অনিকা ভাবতেন, যদি তাদের মতো আমিও এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারতাম! এরমধ্যে অনিকার কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকের পাঠ শেষ হয়। এরপর স্যামসাংয়ে চাকরি নেন। পাশাপাশি বিদেশে চাকরির প্রস্তুতি নেন। শুরুতে টেক জায়ান্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইচ্ছে ছিল তাঁর। এছাড়া যেখানে তাঁর শেখার, জানার ও উন্নতির জায়গা থাকবে–এমন প্রতিষ্ঠান পছন্দের তালিকায় ছিল।
জন্ম-বেড়ে ওঠা এবং যেভাবে ছেড়েছেন দেশ
অনিকার জন্ম সিলেট শহরে। শৈশবে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সবার স্নেহ-মমতার ছায়াতলে বেড়ে উঠেছেন। ছোটবেলায় নির্ধারিত কোনো কিছু হবার স্বপ্ন ছিল না।
তাঁর দাদু একদিন অনিকাকে বলেছিলেন, ‘তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি পাইলট হয়ে প্লেনে চড়ে বেড়াব।’ অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন তাঁর সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে। সেই থেকে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন। এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার ধারণা নেন। দেশ ছেড়ে থাকার ফলে মানুষকে ডিপ্রেশনে ভুগতে হয়। অনিকার জন্য পরিবার ছেড়ে দূরে থাকা খুবই কষ্টকর ছিল। আগে তিনি পরিবার ছেড়ে বড়জোর ঢাকাতে থাকতেন। এখন তিনি অনেক দূরে, চাইলেও পরিবারের কাছে যেতে পারছেন না। আয়ারল্যান্ডে নতুন মানুষজন, পরিবেশ, আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা–এই বিষয়গুলো প্রথমদিকে মানিয়ে নিতে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাছাড়া মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে অনিকা তাহসিন চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ব্যবহার করে মানুষের জীবনকে কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ করছি। আগামীতে এআই নিয়ে আরও বড় কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। তবে এআইয়ের সঙ্গে মানুষ যাতে মনষ্যত্বটাও ধরে রাখতে পারে–তার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাই। স্বপ্ন দেখি দেশ নিয়েও। সুযোগ পেলে দেশের প্রযুক্তি খাতেও অবদান রাখতে চাই আগামীতে।’
সূত্র: সমকাল
আপনার মন্তব্য