মাঈনুল ইসলাম নাসিম

০৩ এপ্রিল, ২০১৬ ১৬:৫৫

দেশবাসীর দুশ্চিন্তা সন্তানেরা জীবিত ফিরবে কিনা, তনু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে শহীদুল মামা

লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ সংরক্ষিত এলাকার অভ্যন্তরে ‘স্মার্ট কিলিং’-এর শিকার সোহাগী জাহান তনুর স্মার্ট কিলারদের বাঁচাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ বা যে কোন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক যে কোন প্রকার গোঁজামিলের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন একাত্তরের দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার শহীদুল হক মামা।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনেন জানেন। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে স্টকহোমে তাঁর স্থায়ী বসবাস।
 
ভিক্টোরিয়ার ছাত্রী নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিহত হবার পর সঠিক ময়নাতদন্ত ছাড়াই কতিপয় অসৎ সেনা-পুলিশ যোগসাজশে তড়িঘড়ি করে লাশ মাটিচাপা দেয়া এবং জনরোষের মুখে ১০ দিন পর কবর থেকে পুনরায় লাশ উঠিয়ে পুনঃতদন্ত পরবর্তী এখন ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র ঘৃণিত ও ন্যক্কারজনক অপচেষ্টারও কঠোর সমালোচনা করেছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা। ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, “দেশবাসীকে আজ দুশ্চিন্তার ভেতরে প্রতিদিনই কাটাতে হয় তাদের মেয়েরা স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরবে কি ফিরবে না”।
 
“আমরা কেন যুদ্ধে গিয়েছিলাম”?- এই প্রশ্ন রেখে  শহীদুল হক মামা জানতে চান, “আমরা কেন সেদিন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম? আমাদের প্রতি যে শোষণ যে সামরিক শাসন যে অবিচার যে ব্যভিচার একাত্তরে খানসেনারা এবং এদেশের কিলার এন্ড কোলাবরেটররা খানসেনাদের দোসর হয়ে যেসব অত্যাচার এবং নির্যাতন করেছিল, তারা কি টিকতে পেরেছিল? টিকতে পারে নাই। ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে প্রোহিবিটেড এরিয়া, রেসট্রিক্টেড এরিয়া। এই যে হত্যাকাণ্ডটা ঘটে গেছে, এটা একটা সহজ ব্যাপার না। সারা বাংলাদেশে মানুষের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, প্রবাসেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে”।
 
সুইডেন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শহীদুল হক মামার আক্ষেপ, “সোহাগী জাহান তনুর সোহাগ কারা কেড়ে নিলো? সে তো বাবা-মায়ের আলালের দুলালি ছিলো। সে তো কোন অন্যায়-অবিচার মানে চারিত্রিক কোন দোষ-ত্রুটি তাঁর ছিলো না। সংসারের ভার কমাবার জন্য টিউশনি করে সে তাঁর পড়াশোনার পয়সা সংগ্রহ করতো। টিচার হিসেবে গিয়ে সে সেখানে লাশ হয়ে পড়ে রইলো ক্যান্টনমেন্টে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনীর প্রধান ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সশরীরে সেই জায়গাটা উনি অবজার্ভ করে এসেছেন, সেটাকে দেখে এসেছেন, কিন্তু আমি তো পেপারে দেখি না হোয়্যার ইজ জিওসি অব ক্যান্টনমেন্ট? কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি সাহেবের কোন সাক্ষাৎকার আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেন? আগে তো আসবে জিওসি, তাঁর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে”।
 
একাত্তরে পাক-হানাদার রাজাকার-বিহারীদের আতংক শহীদুল হক মামার সাফ কথা, “আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মহিলা, আমাদের সংসদের স্পিকার হলো মহিলা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বড় বড় মেজর জেনারেল পর্যন্ত হয়েছে মহিলারা। সব জায়গায় মহিলারা, যেটা পাকিস্তান আমলে কোনদিনও হয় নাই। আজ অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার বলতে চাই, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। এটা সময়ের ব্যাপার, যখন এটার বিস্ফোরণ ঘটবে তখন কেউ সামলাতে পারবে না, যতো বড় দেশপ্রেমিক থাক না কেন”।
 
শহীদুল হক মামা আরো বলেন, “একটা নিরীহ নিরপরাধ মেয়ে, তাঁর আশা ছিলো ভালোবাসা ছিলো, তাঁর স্বপ্ন ছিলো। বাবা-মার অনেক আলালের দুলালী, একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলে কোন দুঃখ ছিলো না, মানে এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। কিন্তু জ্যান্ত একটা সুস্থ মেয়ে যার চেহারাটা ঢাকা থাকতো, সে নাট্যশিল্পী ছিলো, সে ধর্মের কাজও করতো। এমনতো না যে মাথার চুল খুলে সে উলঙ্গভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পর্দানশীন মেয়ে ছিলো, যে কারণে তাঁর চেহারা দেখে সকলেরই মনের ভেতর মায়ামমতা সৃষ্টি হয়েছে, ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। এই মৃত্যুকে কেউ সহজভাবে নিতে চায় না। মানে সোহাগী যে সোহাগে বড় হয়েছে, তাঁর মৃত্যু যে সোহাগে এবং ভালোবাসায় সবার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে, এর পরিণতি হবে ভয়াবহ”।
 
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবনের প্রতিবাদী শহীদুল হক মামা জানান, “সবার মা-বোনের ইজ্জতের দিকে আমাদের তাকাতে হয়। আমরা কথায় কথায় সভা-সমিতিতে বলি, একাত্তরে হানাদার বাহিনীরা আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিলো, অত্যাচার করেছিলো, ব্যভিচার করেছিলো, অন্যায় করেছিলো, যে কারণেইতো মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। আমি কেন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে আমার দেশের মাটি ও মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম? কেন বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না“।
 
হুশিয়ারি উচ্চারণ করে শহীদুল হক মামা বলেন, “ঐ ক্যান্টনমেন্টের খাকি পোশাক ঐ কামান-ট্যাংক কোন কিছুই আমাদেরকে আটকে রাখতে পারে নাই, আর কেউ পারবে না। আজ কেউ যদি গায়ের জোরে কোন অন্যায় অবিচারকে যদি ঢেকে রাখতে চায়, এটার বিস্ফোরণ হবে ভয়াবহ, কেউ তখন ঠেকাতে পারবে না। আমরা কারফিউ ভেঙেছি, বুকের ভেতরে গুলী এদেশের মানুষ পেতে নিয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো, আইয়ুব খান কারফিউ দিয়েও বাঙালির এই বিপ্লবকে ঠেকাতে পারে নাই, ইয়াহিয়াও পারে নাই। অন্যায় অবিচারের জন্যই আমরা গিয়েছিলাম মুক্তি সংগ্রামে। সোহাগী জাহান, আজ তার প্রতিবাদ সারা জাহানে”।
 
“পোস্টমর্টেম কয়বার হয়”?- এই প্রশ্ন রেখে শহীদুল হক মামা স্পষ্ট করে বলেন, “আমার কথা হচ্ছে, পোস্টমর্টেমের যারা আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের বলতে হবে, নিশ্চয়ই পোস্টমর্টেমের রিপোর্টকে অন্যদিকে ধাবিত করার তাদের চেষ্টা ছিলো। কেন দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম হলো ? পোস্টমর্টেমের কী রিপোর্ট এটাও তো দেশবাসী জানতে পারছে না। সে কি ধর্ষিতা হয়েছে? নাকি স্বর্ণের অলংকারে তাঁর আপাদমস্তক ভরপুর ছিলো? তাঁর সেই স্বর্ণ লুটের জন্যই হত্যা করেছে? যদি ধর্ষণ করে থাকে তাহলে মেডিক্যাল রিপোর্টে বেরিয়ে আসবে, ফরেনসিক রিপোর্টে সব বেরিয়ে আসবে। গোঁজামিল মারার কোন রাস্তা নাই”।
 
শহীদুল হক মামা সাবধান করে দিয়ে বলেন, “কোন উপায় নাই, যতো বড় রুই-কাতল-বোয়ালের ছেলে হোক না কেন। সেটা ঊর্ধ্বতন সেনানায়ক হলেও এই অপরাধ থেকে কখনো অব্যাহতি পাবে না। এটা আমার ব্যক্তিগত ওপিনিয়ন। কারণ আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছি, প্রতিবাদ করবো। যে কারণে এই বয়সে, মানে এক পা কবরে দিয়েও আন্দোলন সংগ্রাম থেকে পিছু হটিনি।  আজকে হাঁটতে পারি না, আজকে আমার কিডনি এবং হার্টের অবস্থা খারাপ, নাহলে কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারতো না সুইডেনে। আমি ছুটে যেতাম, আমি গিয়ে আবার আন্দোলনের ডাক দিতাম”।
 
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ ও ধার্মিক শহীদুল হক মামার উচ্চারণ, “অবিচার ব্যভিচার এই হত্যার আমি বিচার চাই”। এই বাংলাদেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ-গনধর্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কোন মা-বাবারা তাদের মেয়েকে কখনো, এমন একটা সময় আসবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়াও বন্ধ করে দেবে। গার্মেন্টস আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান খাত। গার্মেন্টসের একটা কর্মী ছুটির দিনে গিয়েছে খালার সাথে দেখা করতে, এটা কি সম্ভব বাসের ভেতর গণধর্ষণ করা? কোথায় ছিলো আমাদের পুলিশ? তাদেরকে ধরে নর্মাল হাজতখানায় রাখা দরকার? ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলা উচিত। আর ব্রিটিশরা যে সমস্ত আইন-কানুন রেখে গিয়েছে, এগুলো দিয়ে অপরাধীর বিচার হলেও কোনদিন অপরাধ কমবে না। এগুলো সব আইনের ফাঁক, মানুষ খুন করেও বেঁচে যায়”।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত