নিজস্ব প্রতিবেদক

১৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ১৪:৩৯

নারায়ণগঞ্জে সাত খুন : যা ঘটেছিল সেদিন

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীর। ২০১৪ সালে এই শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনের লাশ। সবার হাত-পা বাঁধা লাশের সঙ্গে ঝোলানো ছিল ইটের বস্তা। এমন ঘটনায় শোক আর ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মানুষ। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশ।

সেই ভয়ঙ্কর দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ব্যস্ততম লিংক রোড। সড়কের দুই পাশে স্টেডিয়াম, জেলা আদালত, জেলা প্রশাসক আর পুলিশ সুপারের কার্যালয়। অদূরেই জেলা কারাগার। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাঁধা সেই সড়ক থেকেই দিনে-দুপুরে উধাও হয়ে গিয়েছিল দুটি গাড়িসহ সাতজন মানুষ। তাদের অপেক্ষায়, সন্ধানে পার হয় তিন দিন।

স্বজনদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে মর্মান্তিকভাবে। ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার গাড়িতে থাকা তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন ও লিটন, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের ক্ষতবিক্ষত লাশ। এর একদিন পর মেলে নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের লাশ।

এমন ঘটনায় পুরো নারায়ণগঞ্জ রূপ নেয় শোক, কান্না, আতংক আর ক্ষোভের শহরে। ঘটনার তদন্তে নামে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত র‌্যাব-১১-এর কয়েক অসাধু কর্মকর্তা আর আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন! বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ও চাকরিচ্যুত হওয়ার পর সাত খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হন র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ কয়েকজন র‌্যাব সদস্য।

রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ আর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা ও লাশ গুমের নৃশংস কাহিনী। পুলিশ জানতে পারে, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে অপহরণের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল একটি মামলায় জামিন নিতে নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে আসেন। আর এটি নিশ্চিত হয়ে আসামি মেজর (অব.) আরিফ হোসেন 'অপহরণ' পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব দেন। সাদা পোশাকে একটি টিম নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামিন নিয়ে নজরুল ইসলাম আদালত থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকারে চড়ে বের হন। ওই গাড়িতে ছিলেন তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন ও তাজুল ইসলাম। গাড়ি চালাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর। স্টেডিয়াম এলাকায় যেতেই আসামি আরিফের নেতৃত্বে গাড়িটির গতিরোধ করা হয়। এ ঘটনা দেখে ফেলেন ওই পথ দিয়ে যাওয়া আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক। নজরুলসহ পাঁচজনকে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নেওয়ার দৃশ্যটি নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করেন চন্দন সরকার। এটি দেখে ফেলে অপহরণকারীরা। পরে দুটি গাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে সাতজনকে পৃথক দুটি গাড়িতে তুলে নেয় তারা।

আসামিরা জবানবন্দিতে জানায়, অপহরণ করে সাতজনকে গাড়িতে তুলেই সবার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। এরপর তাদের অচেতন অবস্থাতে কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে রেখে নানা জায়গায় ঘোরানো হয়। আসামি আরিফ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ওই দিন রাতে প্রধান আসামি নূর হোসেনের নির্দেশে অপহৃত সাতজনকে বহনকারী গাড়িটি কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ির ভেতরে থাকা অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখ পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। পরে গলা চেপে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় সাতজনকে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা নৌকায় তোলা হয় সবগুলো লাশ। লাশ গুমের জন্য ইট, রশি ও বস্তা নেওয়া হয় আদমজী ইপিজেড এলাকা থেকে। নৌকার মধ্যেই একে একে প্রত্যেক লাশের সঙ্গে বস্তায় ভরা ইট বাঁধা হয়। এরপর সবগুলো মরদেহ ফেলে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত