সিলেটটুডে ডেস্ক

২৯ মে, ২০১৭ ২৩:০২

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে উপকূলের লাখো মানুষ

ঘূর্ণিঝড় 'মোরা'র কারণে মহাবিপদে আছে উপকূলের মানুষ। মঙ্গলবার সকালে আঘাত হানতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়। এর কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১৭ কিলোমিটার।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর এলাকাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রমকালে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। সোমবার রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময়ও দুর্গত এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছিল।

'মোরা'র কারণে সারাদেশে নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশালে বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ। উপকূলের নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফসলের জমি ও বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় বইছে ঝড়ো হাওয়া।

গত শনিবার বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। সোমবার সকালে তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। থাইল্যান্ডের প্রস্তাবে ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করা হয়েছে 'মোরা', যার অর্থ 'সাগরের তারা'। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৩ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে জানানো হয়েছে, সোমবার রাত ৮টায় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে, কক্সবাজার বন্দর থেকে ৩০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে, মংলা ও পায়রা বন্দর থেকে ৪৫০ ও ৩৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করছিল।

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাগরে চলাচলকারী সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। মংলা ও পায়রা বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর এলাকাকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬২ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ায় ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝড়ের গতি ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার হলে তাকে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের গতি ১১৮ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হলে হারিকেন বলা হয়। ঝড়ের গতি ২১৯ কিলোমিটারের বেশি হলে সুপারসাইক্লোন বলা হয়। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটারের বেশি হলে এবং ঘূর্ণিঝড়টি বন্দরের ওপর বা পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়।

২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর আঘাত হানা সিডরের গতি ছিল ২১৫ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানা আইলার গতি ছিল ১২০ কিলোমিটার। সিডরে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আইলায় প্রাণ যায় ৩২৫ জনের। নিখোঁজ হন আরও অনেকে। সিডর ও আইলার সময়ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। আট বছর পর আবারও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলবাসী।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঘূর্ণিঝড় মোরা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে স্থলভাগে আসবে মোরা। এ সময় ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।

আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া বলেন, 'মোরা' চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে যেতে পারে। ভারি বর্ষণ হলে ঘূর্ণিঝড় শক্তি হারাবে। যত বেশি বৃষ্টি হবে, ততই দুর্বল হয়ে পড়বে মোরা। উপকূল অতিক্রম করার পর মিয়ানমারের দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা ছাড়া দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের একজন আবহাওয়াবিদ জানান, 'মোরা' খুব শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় নয়। তবে আকারে অনেক বড়। ব্যাস অনেক বিস্তৃত। আইলাও খুব শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল না। কিন্তু বিস্তৃত ব্যাসের কারণে অনেক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 'মোরা'র ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা রয়েছে। জোয়ারের সঙ্গে 'সিনক্রোনাইজ' করে সাত থেকে আট ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পারে। তবে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা না থাকার কারণে এমনটা হওয়ার শঙ্কা কম।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সোমবার বিকেল থেকেই চট্টগ্রামে মাইকিং করে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়। সব আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে উপকূলবাসীর জন্য। ডাক্তার ও নার্সদের ছুটি বাতিল করে ২৮৪টি মেডিকেল টিম গঠন করেছে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিস। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে মনিটরিং সেল গঠন করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

বহির্নোঙর ও জেটিতে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ বন্ধ রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কর্ণফুলীতে নোঙর করে থাকা সব জাহাজকে নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বন্দরের বহির্নোঙরে। ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসায় গভীর সমুদ্রে আটকা পড়েছে মাছ ধরার শতাধিক ট্রলার।

প্রস্তুতি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে সব আশ্রয়কেন্দ্র। সিটি করপোরেশনের স্কুলও প্রয়োজনে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ঘূর্ণিঝড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছে সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপজেলার সব আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসে, সে জন্য সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, সীতাকুণ্ড, বাঁশখালীসহ সব উপকূলীয় এলাকায় মাইকিংও করা হচ্ছে।'

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভারি বর্ষণ হতে পারে। ভারি বর্ষণ হলে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত