নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ জুলাই, ২০১৭ ০৫:৩৭

প্রশাসন, আওয়ামী লীগ সকলেই ছিল ইউএনও’র বিরুদ্ধে

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে উপজেলা প্রশাসনের চিঠিতে এক শিশুর (পঞ্চম শ্রেণির) আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিকে কেন্দ্র করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী মো. তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলা, জেলহাজতে প্রেরণ ও জামিনের আগেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল বরিশালের স্থানীয় প্রশাসন। বরিশালের জেলা প্রশাসক ‘কারণ দর্শানোর নোটিশ’ পাঠিয়েছিলেন, এবং উত্তর ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার; একই সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে অনুলিপি পাঠিয়েছিলেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রের এ ছবির ঘটনা নিয়ে আদালতের আগে গত এপ্রিল মাসেই প্রশাসন ক্যাডারের দুই কর্মকর্তা বরিশালের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস এবং বর্তমান জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ জন্য প্রথমে তারিক সালমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন বরিশালের জেলা প্রশাসক। তারিক নোটিশের জবাবও দেন। পরে এই জবাব যায় বিভাগীয় কমিশনারের কাছে। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনার নোটিশ সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সেটি মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠান।

গত ৩ এপ্রিল বরিশালের জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান গাজী তারিক সালমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশটি দেন। আর বিভাগীয় কমিশনার ১৮ এপ্রিল মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পত্র দেন। বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ওবায়েদুল্লাহ সাজু মামলা করেন ৭ জুন। অভিযোগ আমলে নিয়ে চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক আলী হোসাইন ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। এরপর ১৯ জুলাই ইউএনও আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলেও প্রথমে জামিন না দিয়ে জেলহাজতে পাঠান বিচারক, এবং এর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে জামিন দেন তিনি।

ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা ও জামিন নামঞ্জুরের প্রতিবাদ করে অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাতেও। প্রধানমন্ত্রীও প্রতিক্রিয়া জানান। একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা মামলাকে আমলে নিতে বিধি অনুযায়ি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় নি বলেও অভিযোগ ওঠে।

এদিকে, ইউএনও গাজী মো. তারিক সালমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসক তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দায় দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান এপ্রসঙ্গে বলেন, তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে তিনি শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন এবং যে জবাব পাওয়া গিয়েছিল, সেটা কমিশনারের কাছে দিয়েছিলেন। আর বরিশালের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেন, আমন্ত্রণপত্রে জাতির পিতার ছবি প্রথম পেজে না ছাপানোয় জেলা প্রশাসক তাকে (ইউএনও) কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ইউএনও জবাব দিলে সেটি জেলা প্রশাসক তার কাছে পাঠান। কিন্তু জবাবটি তার কাছে যথাযথ মনে না হওয়ায় সেটি মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠান। এরপর আর কিছু তিনি জানেন না।

প্রশাসনের এমন তৎপরতার সময়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। বিচারকের বেধে দেওয়া সময়ের আগেই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন ইউএনও। এরআগে, গত জুনের প্রথম সপ্তাহে তারিক সালমানকে বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে বরগুনা সদর উপজেলায় বদলি করা হয়।

জানা যায়, আগৈলঝাড়া উপজেলায় ইউএনও থাকাকালে তার কিছু সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতারা। ওই সময় তিনি স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেকে ডিগ্রি পরীক্ষায় নকলের জন্যে বহিষ্কার করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়াসহ কিছু ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ।

বিসিএস ২৮তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমান বলেন, আগৈলঝাড়ায় থাকতে তিনি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হতে দেননি। নকল প্রতিরোধে অভিযান চালিয়েছেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনিয়ম ও দুর্নীতি হতে দেননি। এসব কারণে একটি মহল ক্ষুব্ধ ছিল, তারাই হয়তো এসব করেছে।

তবে এতকিছুর পরেও মানুষের সমর্থনে তিনি অভিভূত বলে জানিয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে গাজী মো. তারিক সালমান বলেন, 'আমি আসলে বাকরুদ্ধ। আমি আশা করিনি এত প্রতিক্রিয়া হবে।  মানে এটা আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। আমি দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের পজিটিভ প্রতিক্রিয়ার কারণে আমি আনন্দিত।'

জামিনযোগ্য মামলা হলেও সেদিন তাকে কারাগারে পাঠানোয় বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। দুঘণ্টার কারাবাসে চাকরি ছাড়ার কথাও ভেবেছিলেন। বলেন, "যখন আমাকে কারাগারে পাঠানো হলো তখন মনে হয়েছে যে এই চাকরিটা মনে হয় আমার আর প্রয়োজন নেই। তখন আসলে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। স্ত্রীকে খবর দিয়েছিলাম যে কারাগারে বসে বইপত্র পড়ব। কিন্তু পরে দেশবাসীর যে সাপোর্ট পেলাম। সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সাপোর্ট পেলাম তাতে আমি অনুপ্রাণিত, কৃতজ্ঞ।"

মামলা দায়েরকারী আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দল। শুক্রবার বিকেলে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় মামলার বাদী ওবায়েদুল্লাহ সাজুকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। তাকে কেন চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হবে না, এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ধানমন্ডি কার্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত