সিলেটটুডে ডেস্ক

৩১ জুলাই, ২০১৭ ০৩:২৬

ইউনেস্কোর প্রতিবেদন প্রকাশ, রামপাল প্রকল্পে অনুমতির উল্লেখ নেই

বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্প স্থাপনে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) আপত্তি প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছিল ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রকাশিত সিদ্ধান্তে তার উল্লেখ নেই।

পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সুন্দরবন ও রামপাল বিষয়ে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন রোববার (৩০ জুলাই) প্রকাশিত হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) করতে অনুরোধ করেছে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র। এবং এই সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনো বৃহদাকার শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ না করতে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।

ফলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ইউনেস্কো আগে যেসব আপত্তি তুলেছিল সেগুলো বহাল রইল।

গত ১২ জুলাই বৈঠক শেষ হলেও ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া গেল ১৮ দিন পর। তবে বৈঠক চলাকালেই এটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়, যাতে দাবি করা হয়, ২ জুলাইয়ের অধিবেশনে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে ইউনেস্কো তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে এবং সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এধরনের কিছু উল্লেখ নেই।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের ৭ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে ইউনেস্কো ২০১৬ সালের মার্চে একটি রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন পাঠায়। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত দলটি সুন্দরবন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে দুই পৃষ্ঠার বাংলাদেশ অংশে যে ১১ দফা সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) চালানোর যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, সেটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। এরপর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র সেটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারকে (আইইউসিএন) দিয়ে সেটি পর্যালোচনা করে নেবে।

১১ নম্বর সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়েছে, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। কমিটির ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় ৪৩তম অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা হবে।

এ ব্যাপারে জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ইউনেস্কোর মূল আপত্তি ছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে। তারা খসড়া সিদ্ধান্তে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের যুক্তিতর্কে সন্তুষ্ট হয়ে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। ফলে এখন আর রামপাল প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে বাধা নেই।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও পরিবেশবাদীরা। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে রামপাল পরিদর্শন করে ইউনেস্কো ও পরিবেশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএনের একটি দল। পরে তারা প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে রামপালকে সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ বলে উল্লেখ করে প্রকল্পটি অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সুন্দরবনকে বিশ্বের ঐতিহ্যের মর্যাদা থেকে বাদ দেয়ার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের ৪০টি পরিবেশবাদী সংগঠন খোলা চিঠি দেয় ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের কাছে। সে চিঠি আমলেও নিয়ে সংস্থাটি শুনানির আয়োজন করে।

৪ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অধিবেশনে সুন্দরবন প্রসঙ্গ নিয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোও তুলে ধরা হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, এ বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এরপর ৬ জুলাই সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্প থেকে তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

সরকারের এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সত্ত্বেও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। অবশেষে ৩০ জুলাই প্রতিবেদন প্রকাশ হয় যেখানে আপত্তি তুলে নেওয়া সম্পর্কিত কোন বক্তব্য দেয়নি ইউনেস্কো।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এছাড়া বনের ভেতর দিয়ে কয়লা, সার ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে, এগুলোর কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বিভিন্ন নদীতে প্রায়ই তেল, কয়লা ও সারবাহী ট্যাংকার ডুবে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এগুলো বন্ধের জন্য ইউনেস্কো ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হলেও আমলে নেয়নি সরকার। এর মাঝে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ওপর অত্যাচারটা আরও বেড়ে যাবে। ফলে বিপন্ন হতে পারে এর অস্তিত্ব। তাই সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে উল্টো বিপন্ন তালিকায় অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ পরিবেশবাদীদের।

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো থেকে সুন্দরবনকে বিশ্বের ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দেয়। কিন্তু তার কয়েক বছর পর অর্থাৎ ২০১৪ সালের ১১ জুলাই সরকারকে চিঠি দিয়ে উল্টো সতর্ক করা হয়। ইউনেস্কোর চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এ বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হলে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে সুন্দরবন। নাম লেখাবে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়। এছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় কী উদ্যোগ নেয়া হবে তা উল্লেখ করে ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন চাইলেও এর কোনো উত্তর পায়নি ইউনেস্কো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত