সাখাওয়াত আল আমিন

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০১:৪২

‘সম্পাদনাহীন সংবাদে সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতা হারাচ্ছে’

তথ্য যাচাই-বাছাই না করে কোন ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই অধিকাংশ অনলাইন নিউজপোর্টালের সংবাদ প্রকাশ করার ফলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা নষ্ট হচ্ছে বলে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চ্যানেল আই’র ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ছাদবারান্দায় আয়োজিত ‘বদলে যাওয়া বার্তাকক্ষ: আগামী দিনের সাংবাদিক’ শীর্ষক এক সেমিনারে সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।

ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সম্পাদনাই হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ। কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদপত্রের সংবাদে সম্পাদনার চিহ্নমাত্র নেই। যিনি সংবাদ সংগ্রহ করছেন, তিনিই সেটা আপলোড করছেন এবং সেটা নিয়ে আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি, বহু কিছু করছি, কিন্তু মূল জায়গায় অর্থাৎ এটা যে কোন সাংবাদিকতাই নয়, সেটা অনেক সময় বোঝা যাচ্ছে না।

সাংবাদিকতার নামে যথেচ্ছাচার চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজেদের (সাংবাদিক) আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি না। সাংবাদিকতার নামে যত ধরনের অপসাংবাদিকতা আছে সবকিছু চলছে।

এই যথেচ্ছাচার থেকে মুক্তি এবং সাংবাদিকদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ‘কোড অব এথিকস বা কোড অব কনডাক্ট’ প্রণয়ন করা এবং সেগুলো মেনে চলা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

জনগণকে সুসম্পাদিত সত্য তথ্য জানানো সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুসম্পাদিত একটি পত্রিকা, সুসম্পাদিত একটি বার্তা, সুসম্পাদিত একটি সম্প্রচার মাধ্যম সেটাই জনগণের চাওয়া। কত ধরনের তথ্য আসছে, বিক্ষিপ্তভাবে। এই সব তথ্যকে সংগ্রহ করে সেগুলো সম্পাদনার মাধ্যমে সেটাকে সঠিক সংবাদ ফরম্যাটে নিয়ে আসা একটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ জনগণ সত্যটা জানতে চায়, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য চায়। তাই অনলাইন বা ছাপা পত্রিকা, টেলিভিশন বা রেডিও যে মাধ্যমেই সংবাদ প্রকাশ করা হোক না কেন, সম্পাদনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ সাংবাদিকতার প্রাণই হচ্ছে সম্পাদনা।

সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলালেও সত্য সব সময় অখণ্ড এবং অপরিবর্তিত, এই চিরন্তন বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিকতার এই প্রখ্যাত অধ্যাপক বলেন, অনেক কিছুই বদলে গেছে, সামনের দিনে আরও বদলাবে। কিন্তু যেটি বদলাবে না সেটি হচ্ছে সত্য।তাই সত্যটা আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশ করা, সত্যের সঙ্গে কোন মিশ্রণ না ঘটানোর ওপর জোর দিতে হবে। মানুষ সত্য তথ্য জানতে চায়। কিন্তু কোনভাবেই সত্যের মধ্যে যেন ভুল তথ্য ঢোকানো না হয়।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অনেক গণমাধ্যম আজকাল কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেকে বিকল্প সত্যের কথা বলেন। কিন্তু সত্যের কোন বিকল্প থাকতে পারে না। সত্য একটাই। কিন্তু এর মধ্যে হয়তো দশটা ফ্যাক্ট থাকতে পারে।সেগুলো আপনি তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু বিকল্প সত্যের নামে আপনি দশটা মিথ্যা প্রচার করে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন সেটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

‘‘আমাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন বিশ্বাস থাকে, দর্শন থাকে, আদর্শ থাকে। কিন্তু আমি যখন সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, সেখান থেকে আমি নিজেকে বিযুক্ত রাখবো, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি।’’

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন সাংবাদিকতা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের মত।এখানে বস্তুনিষ্ঠতা থেকে ন্যূনতম বিচ্যুত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বলেন, আমি আমার পাঠককে সত্য জিনিসটা দিতে পারছি কিনা, বস্তুনিষ্ঠভাবে দিতে পারছি কিনা, নির্মোহভাবে দিতে পারছি কিনা। নাকি এখানে আমার প্রতিষ্ঠানের কোন এজেন্ডা আছে, আমার ব্যক্তিগত কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে সে বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে।

‘‘একজন সিনিয়র রিপোর্টার বা সম্পাদক হয়তো চল্লিশ বছর যাবত বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন,দায়িত্ব পালন করেছেন বা সংবাদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ৪১তম বছরে এসে কোন একদিন বা কোন একটি কারণে হয়তো তার অজান্তেই বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এই কারণে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে ‘নিউজ টেস্টের’ মধ্য দিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন সত্য প্রকাশ করাই শেষ কথা নয়, সত্যটার সুবিন্যস্ত প্রকাশ ঘটানোই হচ্ছে সুসাংবাদিকতা। এজন্য সম্পাদকের মাইন্ডসেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘‘সত্যটা শুধু প্রকাশ করলে হবে না নিউজটাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যেন পাঠক আকর্ষণ বোধ করে। সে যেন শিরোনাম দেখেই মনে না করে যে আমার সব জানা হয়ে গেল।’’

সাংবাদিকতায় যারা দীর্ঘদিন থাকতে চান বা এই পেশায় ভবিষ্যৎ গড়তে চান তাদের জন্য আরেফিন সিদ্দিক পরামর্শ দিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যারা সাংবাদিকতায় থাকতে চান, তাদের জন্য আমি একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে চাই, কোনভাবেই যেন বস্তুনিষ্ঠতার ব্যত্যয় না ঘটে। বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের কারণে বার্তাকক্ষ প্রতিনিয়ত কীভাবে বদলে যাচ্ছে এবং আগামীর সাংবাদিকদের কেমন হতে হবে তা তুলে ধরেন চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান।

প্রবন্ধের একটি অংশে তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ধীরে ধীরে হলেও বাস্তবতা বুঝতে পারছে। ডিজিটাল এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য গণমাধ্যমকে তাই আরও বেশি ডিজিটাল হতে হবে। তবে, শুধু যে পত্রিকাগুলো বদলে যাচ্ছে বা তাদেরকে বদলে যেতে হচ্ছে এমন নয়। বদলে যাচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও। লাইভ কাভারেজের জন্য টেলিভিশন সবসময়ই সবার উপরে থাকলেও অডিয়েন্স সেটা কোন মাধ্যমে দেখছে সেটা ভাবতে হচ্ছে তাদের। আগ্রহী কেউ কোন লাইভ কাভারেজ মিস করলে সে পরবর্তী বুলেটিনের জন্য অপেক্ষা না করে মোবাইল ফোনে কত দ্রুত দেখতে পারে সেটা যেমন ভাবতে হচ্ছে, তেমনি এটাও মনে রাখতে হচ্ছে যে সন্ধ্যার প্রাইম নিউজে মানুষ আর দিনের বেলা ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখতে চায় না, তারা ফলোআপের সঙ্গে বিশ্লেষণও চায়।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে বদলে যাওয়া সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, পাঠকের সংবাদ পছন্দের ধরন, সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন ও আয়, সাংবাদিকদের কাজের পরিধি ও সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন আলোচকরা।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন চ্যানেল আই’র পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ।

আলোচনায় অংশ নেন একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ইটিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের ডেপুটি এডিটর শাহরিয়ার খান, এনটিভি অনলাইনের সম্পাদক ফখরুদ্দিন জুয়েল, চ্যানেল আই’র প্রধান বার্তা সম্পাদক প্রণব সাহা, সারাবাংলা. একটি প্রকাতিশতব্য অনলাইনের নির্বাহী সম্পাদক মাহমুদ মেনন খান, বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক শারমিন রিনভী, দেশটিভির বার্তা সম্পাদক সালমা ইয়াসমিন রীতা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র প্রধান বার্তা সম্পাদক গাজী নাসিরউদ্দিন খোকন, বাংলাট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন অর রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিশাত পারভেজ প্রমুখ।

সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন চ্যানেল আই’র বার্তা সম্পাদক আদিত্য শাহীন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত