সিলেটটুডে ডেস্ক

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০২:০১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে সংসদে ক্ষোভ

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে ‘সাংঘর্ষিক এবং আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত’ আখ্যায়িত করে সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা। তারা বলেছেন, এই রায় পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই রায় বাতিলে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তারা।

বুধবার সংসদের বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এর আগে বিকেল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭(১) বিধি অনুসারে প্রস্তাবের (সাধারণ) নোটিশ দেন সরকারের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মইনউদ্দীন খান বাদল। এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সদস্যরা এসব কথা বলেন।

বাদল তার প্রস্তাবে বলেন, 'সংসদের অভিমত এই যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সংবিধানের সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী আলট্রা-ভায়ারস (সাংঘর্ষিক) ঘোষণাকে বাতিল করার জন্য ও মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক জাতীয় সংসদ সম্পর্কে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।'

প্রস্তাব উত্থাপন করে বাদল আরও বলেন, 'প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের পরিষ্কার করে বলতে হবে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ কোথায় মূল কাঠামোকে ধাক্কা দিয়েছে। কোনও বিচারপতি অন্যায়-অবিচার করলে তার অপসারণের পদ্ধতি কী হবে? প্রধান বিচারপতি এমনভাবে বিষয়টি এনেছেন যে, মনে হচ্ছে সংসদের সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ—বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আঘাত করা হয়েছে। অথচ আমরা বিচার বিভাগের পৃথককরণের কোনও স্তম্ভে আঘাত করছি না। এটা আপনি প্রমাণ করতে পারেননি বলেই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনেছেন; যা আনার কোনও অধিকার আপনার নেই। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে অবিবেচনাপ্রসূতভাবে এই সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে।'

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'সংবিধানে বলা আছে, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। আমরা সেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমাদের ছোট করা হলে জনগণকে ছোট করা হয়।'

এই মামলায় আদালতের বন্ধু বা অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যাদের ডাকা হয়েছে, তাদের অতীত ভূমিকা তুলে ধরে তোফায়েল আহমেদ বলেন, "ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগবিরোধী, প্রধানমন্ত্রীবিরোধী। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে তিনি নতুন দল করেছেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত নন। ব্যারিস্টার রোকনউদ্দীন মাহমুদ হাইকোর্টে এক কথা বলেছেন, আপিল বিভাগে আরেক কথা বলেছেন। এ জে মোহাম্মদ আলী 'দৌড় আলী' নামে পরিচিত। হাসান আরিফ বিএনপি নিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ফিদা কামাল ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। আবদুল ওয়াদুদ বিএনপি আমলের অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। টি এইচ খান বিএনপির জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী ছিলেন। একমাত্র আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনী সমর্থন করেছেন। এই আদালতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বা নিরপেক্ষ কোনও অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন না। আসলে এই সংশোধনী বাতিল করবে বলেই এই নয়জনকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেওয়া হয়।"

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বড় কোনও দেশে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নেই। এ ব্যবস্থায় কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রথমেই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব কাজ রাষ্ট্রপতি করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। তা হলে আলটিমেটলি এটা নির্বাহী বিভাগের হাতেই এলো।' তিনি বলেন, 'আমাদের নেওয়া ব্যবস্থা অধিকতর গ্রহণযোগ্য।'

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'বেশি কথা বলা ভালো নয়। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমাকে মিস কোট করা হয়েছে। যে বেশি কথা বলে তাকেই তো মিস কোট করা হয়। এর আগে কোনও প্রধান বিচারপতি নিয়ে এত বিতর্ক হয়নি।'

তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আমাদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিরা পরিপক্ব। অথচ আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিতরা অপরিপক্ব! আমাদের এখানে অনেকেই গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। আমরা যখন সংবিধান প্রণয়ন করি, তখন এই বিচারপতিদের মধ্যে অনেকেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।'

একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ চিঠি দিয়ে আটকে দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কী বিস্ময়কর ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ দুদক তদন্ত করতে পারলেও বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা যাবে না!'

তিনি আরও বলেন, 'রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাহী ও আইন বিভাগ শেষ। বিচার বিভাগের অবস্থা ডুবুডুবু—এই মন্তব্য করে তিনি বাংলাদেশকে ডিসফাংশনাল (অকার্যকর) বলতে চেয়েছেন। কখন তিনি একাজ করলেন? যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই রায় দিয়ে তিনি বিএনপিকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করছেন।'

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'দুনিয়ার কোথাও বিচার বিভাগ জবাবদিহির বাইরে নেই। তার মতে, দেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগে কোনও আইন না থাকায় এবং সুষ্ঠু পদ্ধতি না থাকায় এ ধরনের জটিলতা ও রায় এসেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারকরা অনেক বেশি সুরক্ষিত ছিলেন। কারণ কোনও বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া তদন্ত শুরু করা যাবে না। এমনকি তদন্তে প্রমাণিত হলেও তাকে অপসারণে রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাগবে।'

প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, 'রায় প্রতিষ্ঠিত করতে একটি পত্রিকা বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কেন নিয়েছে তা জানি না। এই রায়ে বিএনপি নেতা মাহবুবউদ্দিন খোকন দুই মণ মিষ্টি বিতরণ করেছেন। বিএনপি নেতা মওদুদ নিজ হাতে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন।'

আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী বিচারপতিদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'ষোড়শ সংশোধনীর রায় কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য করা হয়েছে? জিয়াউর রহমানের অবৈধ সামরিক শাসনের মাধ্যমে বর্ণিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল তাদের পছন্দ? সর্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান বাহাত্তরের সংবিধানের গণতান্ত্রিক বিধান তাদের পছন্দ নয়?'

বিচারকদের অপসারণে বিভিন্ন দেশের বিধান তুলে ধরে তিনি বলেন, 'এসব গণতান্ত্রিক দেশের বিধান তাদের পছন্দ নয়। কেন এই পাকিস্তানপ্রীতি?'

ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আইনজীবীদের সমালোচনা করে ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী বলেন, 'ড. কামাল হোসেন নিজেকে সংবিধানপ্রণেতা হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু যিনি তার সৃষ্টির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিনি প্রতারক, সুবিধাবাদী। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদরাও বর্ণচোরা, তাদেরও চেয়ারের খায়েশ! কয়দিন তারা রোদে ঘুরেছেন, জনগণের কাছে গেছেন? জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না বলে শর্টকাট রাস্তা খুঁজছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রধান বিচারপতি কি তার সম্পদের তথ্য গোপন করতে পারেন? আয়করের তথ্য গোপন করতে পারেন? স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাটের তথ্য গোপন করতে পারেন? এগুলো থেকে রেহাই পেতেই তড়িঘড়ি করে এই আল্ট্রাভায়ারস রায় দিয়েছেন। তিনি যেসব কাজ করছেন, যেসব কথাবার্তা বলছেন, তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিচার বিভাগ ধ্বংসের জন্য তাকেই দায়ী করবে।'

স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, 'সঠিকভাবে আমরাই একমাত্র বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে চাই। এজন্য সরকারের ভালো কাজের যেমন প্রশংসা করি, তেমনি খারাপ কাজের গঠনমূলক সমালোচনাও করি। এই সংসদ প্রাণবন্ত। ১৯৭৩ সালের পর এত প্রাণবন্ত সংসদ আর হয়নি।'

আলোচনায় আরও অংশ নেন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও স্বতন্ত্র সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত