স্পোর্টস ডেস্ক

১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০১:৪৯

এই অলক, সেই পুরোনো অলক!

বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি আক্ষেপের, হাহাকারের নাম। বাংলাদেশের ক্রিকেটে হারিয়ে যাওয়া হারাধনের ছেলেদের একজন যেন। ভালোই খেলছিলেন। শুরু থেকেই জাতীয় দলের মিডল অর্ডারের ভার বয়ে নিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক তাঁর মুঠো থেকে বেরোনোর সৌজন্যেই দেখেছে বাংলাদেশ।

কিন্তু সেই অলক হুট করে হারিয়ে গেলেন। নাম লেখালেন বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএলে। এর পর নির্বাসন শেষে আবারও ফিরেছেন মূল স্রোতে। জাতীয় লিগে কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য মাঝে মধ্যেই আলোচনায় এসেছিলেন। কিন্তু নিমিষেই যেন সব আলো কেড়ে নিলেন নিজের দিকে। ম্যান অব দ্য ফাইনাল।

ম্যাচের শেষ ৯ বলে ২৩ রান দরকার ছিল কুমিল্লার। হাত থেকে ছিটকে যাচ্ছিল ম্যাচ। বেশ অনেকক্ষণ উইকেটে থেকেও তখনও ডানা মেলতে পারেননি অলক। ২১ বলে রান ছিল ১৮।

সেখান থেকে হঠাৎ করেই ঝড় তুললো অলকের ব্যাট। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার সেরা সময়কে মনে করিয়ে দেওয়া দারুণ সব শটে অসাধারণ এক জয় এনে দিলেন কুমিল্লাকে।

ফাইনালের স্নায়ু চাপ সামলে ৯ বলে ২৩ রানের কঠিন সমীকরণ মিলিয়ে দিয়েছেন তিনিই। ৮ বলে ২১ দরকার এমন মুহূর্তে মেরেছেন টানা চারটি চার।

এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, গ্যালারির তীব্র গর্জন, ফ্লাড লাইটের কুয়াশামাখা আলোর সঙ্গে মিশে থাকা চাপের বিন্দু স্পর্শ করছে তাঁকে। ফিরলেন সেই অলক, বহু আগের অলক।

এমন একটা ইনিংস খেলে, সতীর্থদের উদযাপনের কেন্দ্রে থেকেও অলক পেছন ফিরে আর তাকাতে চান না। চোখ সামনেও, সেটিও খুব সুদূরে বিস্তৃত নয়। অলক স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, নিজেকে প্রমাণ করার কোনো তাগিদ নেই। কাউকে পাল্টা জবাবও দিতে চান না। শুধু তাঁর ওপর যে আস্থা রেখেছিল কুমিল্লা, দিতে চেয়েছিলেন সেটিরই প্রতিদান।

খেলোয়াড়দের লটারিতে কোনো দলই নেয়নি তাঁকে। পরে মাশরাফি বিন মুর্তজার অনুরোধে কুমিল্লা দলে জায়গা পান।

অলক বলছিলেন, ‘গত বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভালো খেলেছিলাম। দুটো ডাবল সেঞ্চুরি ছিল। ভেবেছিলাম বিপিএলের কোনো দলে ডাক পাব। কিন্তু কেউ ডাকেনি। এর পর যখন কুমিল্লা ডাকল, আমার চেষ্টা ছিল ওদের আস্থার, বিশ্বাসের প্রতিদান দেওয়া। আমার ​একটা বিশ্বাস ছিল একটা ম্যাচে হলেও ভালো কিছু করতে পারব। যখনই ওপরের দিকে ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাব নিজেকে প্রমাণ করে দেব। চেষ্টা করি প্রতিটা ম্যাচেই ভালো করার। সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই ম্যাচে সুযোগ পেয়েছি। আসলে এর আগে বেশির ভাগ ম্যাচেই ভালোভাবে জিতেছি। এ জন্যই সেভাবে সুযোগ পাইনি।’

ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলার পরও প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ এই বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন, অলক এই মুহূর্তে নির্বাচকদের ‘প্ল্যান বি’তেও নেই। ৩১ বছর বয়সী অলক নিজেও বাস্তবতা বোঝেন, ‘আসলে কাউকে বার্তা-টার্তা দেওয়া—এ রকম কোনো কিছু না। গত দুই তিন বছরে চেষ্টা করে যাচ্ছি ভালো খেলার। প্রতি বছরে লক্ষ্য ঠিক করি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কিংবা প্রিমিয়ার লিগে ভালো করার। এই ইনিংসটাকে আমি কামব্যাকও বলব না। আমাদের এখনকার জাতীয় দল খুব ভালো খেলছে। আমার কাছেও ভালো লাগে ওদের খেলা দেখে। ভেবে গর্ব হয়, এই দলে আমিও খেলে​ছি। ওভাবেই চিন্তা করি।’
আর আইসিএ, যে বিদ্রোহী টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরিটাই এসেছিল তাঁর ব্যাটে? অলকের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘আইসিএল অনেক আগের ব্যাপার। এটা এখন অতীত। এ নিয়ে না কথা বলাই ভালো।’

অলক জানালেন, কাল এক মুহূর্তের জন্যও নিজের ওপর, দলের ওপর থেকে আস্থা হারাননি। এমনকি শেষ ওভারে ১৭ রানের সমীকরণও যদি লাগত, সেটিও মিলিয়ে দিতে পারতেন। এটাই তো সেই অলক, সেই আত্মবিশ্বাসী অলক। যা প্রতিধ্বনিত হলো তাঁর কথায়, ‘আমার পরিকল্পনা ছিল শেষ পর্যন্ত খেলে যা​ওয়া। বিশ্বাস ছিল, শেষ পর্যন্ত খেললে দলকে জেতাতে পারব। উইকেটে খুব ভালোভাবে বল ব্যাটে আসছিল। আমার মনে হয়েছে, শেষ ওভার পর্যন্ত খেলতে পারলে ওই ওভারে ১৭ রান লাগলেও তুলতে পারব।’

আর শেষ বলে যখন দরকার এক রান? কী ছিল অলকের পরিকল্পনা? ‘কুলাসেকারাকে (শেষ ওভারের ব্যাটিং সঙ্গী) বলেছি, কোনো ঝুঁকি নেব না। এক রানই নেব। ঝুঁকি নিতে গেলে আউট হয়ে যেতে পারি। তখন ম্যাচ যাবে সুপার ওভারে। দলের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। সেটা ভালোভাবে করতে পেরেছি ভালো লাগছে।’

কত দিন পর ম্যাচ সেরা হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে, ম্যাচ বিতরণী অনুষ্ঠানে। সে-ই প্রথম তাঁকে একটু অনভ্যস্ত লাগল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। অলক জানালেন, এই ইনিংসটি তাঁর ক্যারিয়ারেরই দ্বিতীয় সেরা, ‘বাংলাদেশ দলের হয়ে সেঞ্চুরি করেছিলাম ভারতের বিপক্ষে (২০০৮ এশিয়া কাপ, করাচি)। আমাদের দ্রুত চারটা উইকেট পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই সেঞ্চুরি করি। আজকের ইনিংসটা খুব দরকার ছিল। পুরো টুর্নামেন্টে আমরা ভালো খেলেছি। শেষ ম্যাচটা ভালো খেলতে না পারলে ভালোভাবে শেষটা হতো না। খুব দরকার ছিল জয়টা।’

এটাই অলক, যিনি নিজের চেয়ে দলের কথাই ভাবেন আগে। এই অলক, সেই পুরোনো অলক! 

উল্লেখ্য,মঙ্গলবার বিপিএল এর ফাইনালে অলক কাপালীর ২৮ বলে ৩৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে হারতে থাকা ম্যাচে বরিশাল বুলসকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত