একুশ তাপাদার

১০ নভেম্বর, ২০১৬ ১২:০৭

বাংলাদেশের ১৬ বছরের টেস্ট কাহন

ছবি: Getty Images

এবারের ইংল্যান্ড সিরিজের আগে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হত, টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশকে কেমন মনে করেন? বেশিরভাগ উত্তরেই হয়ত আসত - 'নড়বড়ে', 'অপরিপক্ব', 'অপেশাদার', 'অগোছালো', 'আত্মবিশ্বাসহীন' এই শব্দগুলো। টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ মানে যেন ছিল লম্বা বিরতি দিয়ে খেলতে নেমে অস্বস্তিতে ভোগা দল। প্রায়ই আনকোরা দুই তিন ক্রিকেটারের একসাথে অভিষেক ঘটিয়ে অনভিজ্ঞতায় ভরা দল, কোনভাবে ইনিংস পরাজয় এড়িয়ে খেলা পাঁচ দিনে নিয়ে যাওয়া কিংবা হঠাৎ কোন ম্যাচে রোমাঞ্চকর জয়ের সম্ভাবনা জাগালেও অবধারিতভাবে হেরে যাওয়া দল।


সম্প্রতি একদিনের ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত শক্তিতে পরিণত বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরই এক অস্বস্তির নাম। মিরপুর টেস্টে তিনদিনেই ইংল্যান্ডকে ১০৮ রানে হারিয়ে যখন বাংলাদেশ দল উৎসবে মাতোয়ারা তখন আনন্দ উল্লাসের চেয়েও তাই এই অস্বস্তি তাড়ানোর তৃপ্তিই বেশি দেখা গেছে মুশফিক-তামিমদের চেহারায়। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট জয়ে সব ভোজবাজির মত পাল্টে যায়নি। ঘরোয়া ক্রিকেট আগের জায়গাতেই আছে। তবে দীর্ঘ পরিসরে ১৬ বছর ধরে খুঁজে ফেরা আত্মবিশ্বাস নামক টনিক পাওয়ার দাবি করলে দ্বিমতের জায়গা সামন্যই।

১৬ বছরে ৯৫টি টেস্ট। ৮ জয়, ১৫ ড্র আর ৭২ পরাজয়। পরিসংখ্যান হিসেবে একেবারেই সাদামাটা, বিবর্ণ! তবে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে সাদা পোশাকে নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের  টস থেকে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর অ্যালিস্টার কুকের সাথে মুশফিকুর রহিমের ট্রফি ভাগাভাগির মধ্যের সময়ের এই পরিসংখ্যানের বাইরেও আছে অনেক নিবেদনের গল্প, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হতাশা, ভুল আর আক্ষেপের গল্প। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের পথচলা, এগিয়ে যাওয়া কিংবা হোঁচট খাওয়া এবং ফের ঘুরে দাঁড়ানোর সকল প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করতে চাইলে পরিসংখ্যানের নির্দিষ্ট খাপে আটকে থাকার তাই উপায় নেই।

 

অনেকের মতে তৎকালীন কর্মকর্তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার জোরেই বাংলাদেশ প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় টেস্ট মর্যাদা পেয়ে যায়। ঘরোয়া পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট চালুর আগে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার বিরল উদাহরণ এই মতকেই সমর্থন করে। এই মতকে আরও শক্তিশালী করে অভিষেক টেস্টের কিছু ঘটনাও। ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সে টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার পর ম্যাচ চলাকালীন অবস্থাতেই বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম নাকি পরিণত হয়েছিল অবাধ যাতায়াত আর শুভেচ্ছা বিনিময়স্থলে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্রীড়া সংগঠক যারই সুযোগ আছে তিনিই একবার ওখানে গিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দিয়ে আসছিলেন 'বিনামূল্যের পরামর্শ'। এসব দেখে কলকাতার এক সাংবাদিক পরে এক কলামে লিখেছিলেন - 'বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম তখন অনেকটা বাজার, যে যার মত ঢুকে টিপস বিলিয়ে হৈ হুল্লোড় করছিল'। একটা টেস্ট ম্যাচ যে কতটা মনসংযোগ আর পেশাদারিত্বের সাথে খেলতে হয় তা জানার জায়গা যথেষ্ট ছিল না তখন। ফলস্বরুপ দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে অলআউট হয়ে বড় ব্যবধানে ৪ দিনেই হেরে যায় বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংস বলেও যে একটা ব্যাপার আছে চরম অপেশাদার শুরুতে বাংলাদেশ দলের হয়ত তা মাথাতেই ছিল না। বড় দলগুলোর সাথে অনেক ম্যাচে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয় ইনিংস ব্যর্থতায় হেরে যাওয়ার অনেক উদাহরণ পরেও দেখা গেছে।   

অভিষেক টেস্টের সেই অগোছালো পরিবেশের ড্রেসিং রুম পরবর্তীতে আর দেখা না গেলেও বাংলাদেশের টেস্ট প্রস্তুতির ভিত্তি ঘরোয়া ক্রিকেট এগিয়েছে  অনেকটা পিকনিক আমেজে। যার প্রভাব পড়েছে মাঠের ক্রিকেটে। প্রায় প্রতি টেস্টেই নতুন নতুন ক্রিকেটারের অভিষেক, সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে না পাওয়া আর  একের পর এক ইনিংস পরাজয়ে বাংলাদেশ তখন বিশ্ব ক্রিকেটের কুলিনদের কাছে হাসির পাত্র। যদিও টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায় প্রথম জয় প্রায় পেয়েই গিয়েছিল খালেদ মাহমুদ সুজনের দল।  ২০০৩ সালের ওই পাকিস্তান সফর হতে পারত বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের সিরিজ। আজও অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেন মুলতান টেস্ট জিতে গেলে অনেক আগেই টেস্টে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যেত বাংলাদেশ। বাজে আম্পায়ারিং, ইনজামের অতিমানবিয় ইনিংস, রফিকের ক্রিকেটীয় উদারতায় আক্ষেপ আজও পোড়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। মুলতানে পাকিস্তানের কাছে ১ উইকেট হার সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আক্ষেপের পরাজয়। মাঠে সামর্থ্যের শতভাগেরও বেশি দিয়ে চোখ মুছে সুজনের বেরিয়ে আসার দৃশ্য নিবেদনের গল্পও বলে দিচ্ছিল। এর দুই বছর পর ২০০৫ সালে দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে টেস্টে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। তবে দুর্বল হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশের মাটিতে জয়টা একরকম প্রত্যাশিতই ছিল।

 

টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মম অভিজ্ঞতা হয় ২০০৩ সালের অস্ট্রেলিয়া ও ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরে। ২০০৩ সালে অস্ট্রলিয়া সফরের আগে সেদেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার  ডেভিড বুন তাচ্ছিল্য করে বলে বসলেন অস্ট্রেলিয়ার সাথে একদিনেই টেস্ট হারবে বাংলাদেশ! এত অপমানজনক কথার জবাব দেয়ারও পরিস্থিতি ছিল না তখন। বাংলাদেশ অবশ্য একদিনে হারেনি। স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বে পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায় রাজত্ব করে বেড়ানো অজীদের কাছে দুটি টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারলেও খেলা গড়িয়েছিল ৩ ও ৪ দিন পর্যন্ত। ২০০৬ সালে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে অবশ্য একটা জবাব দিতে পেরেছিল বাংলাদেশ। ফতুল্লায় শাহরিয়ার নাফিস আর মোহাম্মদ রফিকের নৈপুন্যে রিকি পন্টিংয়ের বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে একেবারে ব্যাকফুটে ফেলেও ৩ উইকেটে হেরে হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। 

 

২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে খেলতে গেলে হাবিবুল বাশারের দলকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতে উঠে ব্রিটিশ মিডিয়া। খেলার আগেই বাংলাদেশকে ১০০ রান বোনাস দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে তাচ্ছিল্য করা হয়। দুটি টেস্টই আড়াই দিনে হেরে যাওয়ায় সেখানকার প্রভাবশালী গণমাধ্যমে লেখা হয় ‘ভবিষ্যতে এই বিতিকিচ্ছিরি বাংলাদেশ দল যেন লর্ডসের ১০০ মাইলের মধ্যে পা রাখতে না পারে।’  বাংলাদেশ অবশ্য পরেও লর্ডসে পা রেখেছিল। ২০১০ সালের সেই সফর শেষ করেছিল অনেকটা সগৌরবেই। অসাধারণ সেঞ্চুরি করে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লিখিছিলেন তামিম ইকবাল। ৫ উইকেট নিয়ে পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীবের নামও উঠেছিল বিখ্যাত ওই বোর্ডে। ওই সিরিজের তামিম আরেকটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। দুটি টেস্ট যথারীতি হারলেও খেলা গড়িয়েছিল পঞ্চম দিন পর্যন্ত।

কিন্তু ওই সিরিজের পরই ১৪ মাসের বিরতির পর জিম্বাবুয়ের সাথে খেলতে নেমে হেরে যায় বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময়ের বিরতি বাংলাদেশের ১৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে আরও এসেছে। ২০০৬ সালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে কাঁপিয়ে দেয়া সেই সিরিজের পরও খেলার মধ্যে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৩ মাসের বিরতিতে পড়ে ফের খেই হারিয়েছে সাদা পোশাকে। বিরতিতে এমন খেই হারানোর ঘটেছে কয়েকবার। টেস্টে বিরতি পড়ার সর্বশেষ নজির  ২০১৫ সালে জুনে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সিরিজের পর প্রায় ১৫ মাস পরে ইংল্যান্ডের সাথে সিরিজ। পরিণত, পরিকল্পিত বাংলাদেশ এবার অবশ্য খেই হারায়নি। তবে সিরিজের আগে সাকিব আল হাসান আক্ষেপ করে বলছিলেন- 'টেস্ট ক্যারিয়ারে ৩ বছর কোন ম্যাচ না খেলেই তো হারিয়ে গেল।'

 এই ১৬ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছে শ্রীলঙ্কার সাথে ১৬টি আর সবচেয়ে কম অস্ট্রেলিয়ার সাথে মাত্র ৪টি। বর্তমান দলের সাকিব, তামিম কেউই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এখনো টেস্ট খেলারই সুযোগ পাননি। অথচ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া প্রতিবছরই নিজেদের মধ্যে অন্তত ১০টি টেস্ট খেলে থাকে। ২০০০ সাল থেকে পুরো বাংলাদেশ দল যেখানে খেলেছে ৯৫ টেস্ট, ২০০৬ সালে অভিষেকের পর বর্তমান ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুকই খেলে ফেলেছেন ১৩৫ টেস্ট। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় কতটা কম টেস্ট খেলার সুযোগ হয় বাংলাদেশের। তবে এজন্য আইসিসির এফটিপি যতটা দায়ি, বিসিবির দায়ও কম না। খোদ বিবিসিই নিজেদের সিদ্ধান্তে  একাধিকবার টেস্ট খেলার সুযোগ হাতছাড়া করেছে।

১৬ বছরে দলীয় অর্জন হৃষ্টপুষ্ট নয়। তবে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত কিছু ঝলক দেখা গেছে অনেকবারই। অভিষেক টেস্টেই রেকর্ডের পাতায় নাম লিখিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫, নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের ৬ উইকেট। হাবিবুল বাশার সুমনের ধারাবাহিকতা, মোহাম্মদ রফিকের প্রভাব বিস্তারকারী বোলিং, মাশরাফির অল্প পুঁজি নিয়ে তীব্র লড়াই।  কলম্বোত সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুল সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড, পেশোয়ারে অলক কাপালীর হ্যাট্টিক। এসব ব্যক্তিগত অর্জনে এক সময় খুশি থাকত বাংলাদেশের সমর্থকরা। তবে দিন পাল্টেছে, আমূল পাল্টে গেছে মানসিকতা। তামিম ইকবাল এখন ডাবল সেঞ্চুরি করেও খুশি থাকেন না,  সাকিবের হরহামেশা পাওয়া ৫ উইকেটেও থাকে না বাড়তি উচ্ছ্বাস। বাংলাদেশ দল এখন জয়ের জন্যেই খেলে। সমর্থকরাও জয় দেখার আশা করে খেলা দেখতে বসেন। বাংলাদেশ না জিতলে মেহেদি হাসান মিরাজের ম্যাচে পাওয়া ১২ উইকেটও খুব উচ্ছ্বাসের হত না।

এবার যেমন ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট জিতে সহ-অধিনায়ক তামিম ইকবাল আকাশে উড়তে চাইলেন না। অকপটে বলে দিলেন, "বড় দলের সাথে এক টেস্ট জিতেই বাংলাদেশ টেস্টেও খুব ভালো দল হয়ে গেছে মনে করার কোন কারণ নেই,  টেস্টে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে।" এই বাস্তবতার বোধ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে। তবে বোধ থাকলেই তো সাফল্য ধরা দিবে না। সেজন্য দরকার ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নয়ন, নিয়মিত খেলার সুযোগ, সঠিক পরিকল্পনা,  দল পরিচালনা ও দল নির্বাচনে স্থিতধী মনোভাব।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সম্প্রতি বলেছেন - "ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি কোন ফরম্যাটেই আমাদের র‍্যাংকিং সাতের নিচে নামানো যাবে না।" ওয়ানডেতে সাতে থাকা বাংলাদেশ বাকি দুই ফরম্যাটে পিছিয়ে আছে খানিকটা।

সব কিছু ঠিক থাকলে ২০১৭ সালে ১১টি টেস্ট খেলার কথা বাংলাদেশের। কে জানে টেস্টেও দলীয় রেকর্ড হৃষ্টপুষ্ট করার যাত্রাও হয়ত শুরু হতে পারে সামনের বছর থেকেই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত