একুশ তাপাদার

২০ জুন, ২০১৭ ১৭:৩৫

ছন্দহারা এ কোন মোস্তাফিজ?

প্রত্যন্ত সাতক্ষীরা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে গোটা দুনিয়া। বোলিং ভোজবাজির গোটাকয় ঝাঁকিতে আবির্ভাবেই বাজিমাত। নড়াইলের মাশরাফি প্রায় গোঁধরে নেট বোলার মোস্তাফিজকে মাঠে নামিয়েছিলেন। রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটান সাতক্ষীরার ছেলে। একে একে পাকিস্তান, ভারত, সাউথ আফ্রিকা। চোখ কপালে তুলেছে ক্রিকেট দুনিয়া। অথচ কোথায় গেল সেই তেজ, সেই ছন্দ! দুশ্চিন্তা বাড়ছে সবার, কী হলো মোস্তাফিজের?  কী গলি তস্য,  কী চায়ের দোকানের আড্ডা,  কী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্দরমহল। এখন ভারি আলোচনার অন্যতম বিষয় কাটার মাস্টার রহস্য। কি হলো তার?

ফিল্ডিংয়ের সময় ডাইভ দিয়ে শোল্ডারের লেব্রাম ছিঁড়ে গিয়েছিল বোলিং বিস্ময় টাইগারের। সারাতে অপারেশন হয়েছে, খেলায় ফিরেছেন মোস্তাফিজ। কিন্তু ফেরেনি আগের ধার। নিউ জিল্যান্ডে সফরে একদম সাদামাটা। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে ওয়ানডেতেও একই হাল। আয়ারল্যান্ডে ট্রাই নেশন কাপে কিছুটা ছন্দ দেখিয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে গিয়েই আবার টালমাটাল। বাহারি স্লোয়ার আর কাটারে ভ্যাবাচাকা খাওয়া ব্যাটসম্যানরা এখন বেদম পিটাচ্ছেন বাঁহাতি পেইসারকে। চার ম্যাচ খেলেউইকেট তুলেছেন মাত্র একটি। ওভার প্রতি প্রায় সাড়ে ছয় করে রান দিয়েছেন। কোন ম্যাচেই তাকে দিয়ে ১০ ওভার বল করানো যায়নি। সেমিফাইনালে তো এমন মার খেললেন তাকে দিয়ে ছয় ওভারের বেশি বল করানোর সাহসই করেননি মাশরাফি!

‘এখন মোস্তাফিজকে দেখলে মনে হচ্ছে পুরোপুরি অন্যরকম। আগের যে ফ্লুয়েন্সি ছিল, স্বাচ্ছন্দ্য ছিল এগুলো নেই।’ এ কথা, বাজ পাখির মতো শ্যেন দৃষ্টিতে রেখে নিজ সন্তানের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে জাতীয় দল পর্যন্ত মোস্তাফিজকে লালন করা ওস্তাদ সারওয়ার ইমরানের। রীতিমতো উদ্বিগ্ন তিনি। শিষ্য তো আর আগের মতো নেই, ‘লেগ স্টাম্পের বাইরেই বল করছে, মার খেয়েছে। অ্যাকিউরেসি কমে গেছে। তার যে স্লোয়ার, রিড করা কঠিন ছিল। ওর বোলিংয়ে কোনো ক্লু ছিল না। এখন বোঝা যায় এটা স্লোয়ার। এটা লাইন চেন্জ হওয়ার কারণে হইসে। আগে যখন জাম্প কইরা ওর ব্যাকফুটল্যান্ড করত, স্টাম্পের খুব ক্লোস থেকে করত। এখন একটু দূর থেকে করে। কেন করে আমি জানিনা। সেজন্য লাইনটা চেন্জ হয়ে গেছে।’

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার আগে টাইগার অধিনায়ক মাশরাফির ইঙ্গিত ছিলো, হানিমুন শেষ,এখন সংসারের কঠিন হিসাববুঝে নেয়ার সময়। বলছেন,  ‘ও এখন যেটা করছে এটাই নর্মাল। এরআগে যেটা পেয়েছে ওটা অ্যাবনর্মালিটি ছিল। ওকে ব্যাটসম্যানরা রিড করছে, এখন খেটে উইকেট নিতে হবে।’

মাশরাফির সঙ্গে একমত নন ইমরান। ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো এক সময়ের পেইসারের রিডিং, এখনকার মোস্তাফিজই অ্যাবনর্মাল। তিনি নিশ্চিত, এখনো মোস্তাফিজ-ধাঁধার সমাধান বেরোয়নি। তাঁর বিশ্বাস, আসলে স্টকের রসদগুলো ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছেন না কাটার মাস্টার। ইমরানের সঙ্গেই বরং মতের মিল বোর্ডের গেইম ডেভলপমেন্টের থিঙ্কট্যাঙ্ক নাজমুল আবেদিন ফাহিমের,‘মাশরাফির সঙ্গে আমি একমত না। ওর মানের বোলারওয়র্ল্ডে কম। ও এক্সট্রা অর্ডিনারি। একটা ইনজুরিতে এত কিছু হওয়ার কথা না। কারণ ওর স্লোয়াররিড করার মতো পাওয়ার ব্যাটসম্যানদের ছিল না। হয়ত অনেকে বলবে ভিডিও দেখে বুঝে, কিন্তু ভিডিও দেখে বোঝা আর মাঠে অ্যাপ্লাই করা অনেক টাফ। মেইনলি ওর লাইন চেন্জ হইসে।’ এক সময়ের আর্লি অর্ডারের মারকুটে ব্যাটসম্যান এখনও রিড করে যাচ্ছেন বোলারদের ডেলিভারি স্ট্রাইড, গ্রিপ আর ফলো থ্রু, ‘ও স্টাম্প থেকে সরে ডেলিভারি করছে। এতে লাইনবদলে যাচ্ছে। আমার মনে হয় মোস্তাফিজ নিজেও এটা বুঝতে পারছে না। ইনজুরি থেকে ফেরার পর কেউ এটা বলেছে কিনা জানি না। কিংবা ইনজুরিতে কিছু হয়েছে কিনা তা বলতে পারছি না।’

নিজে পেইসার বলে গতির বোলারদের মনের অবস্থা ভালোই বোঝেন ইমরান। চমক দিয়ে আবির্ভূত মোস্তাফিজকে সাধারণের কাতারে দেখতে নারাজ তিনি, ‘ওর সমস্যা সিম্পল। আগের লাইনে বল করতে হবে। তাইলেই হবে। দলের সঙ্গে যাঁরা আছেন তাঁরা কী বলছেন তা তো আমি বলতে পারব না। তবে ও সাধারণ কাতারে নামার মতো বোলার নয়।’

টেকনিক্যালিটির বিচারে সমাধান খুঁজেছেন ফাহিমও, ‘বল ডেলিভারি আগের চেয়ে তাড়াতাড়ি দিচ্ছে, অ্যাঙ্গেল করছে। সোজা করলে আমার মনে হয় ওর সমস্যা কেটে যাবে। তাতেও যদি না হয়পরে ভাবতে হবে কী করা যায়।’

মোস্তাফিজের অপারেশন হয়েছে ইংল্যান্ডে। পুরো দেখভাল করেছেন বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ রায় চৌধুরী। জানালেন মোস্তাফিজ ঠিক আগের মতোই খেলতে পারেন বলে দিয়েছেন ডাক্তাররা, ‘ওকে আমরা বলেছি চিন্তার কারণ নাই। চাইলে হাজার মাইল বেগেও বল করতে পার। বোলিংয়ে কোনো চাপ পড়বে না। মেডিকেলদিক থেকে দেখতে গেলে, একজন পেইসারের যে প্যারামিটারগুলো দেখতে হয় স্ট্রেংথ, ফ্লুয়েন্সি সব দিক থেকে সে ফুললি ওকে।’

মোস্তাফিজ না হয় ফিজিকালি ফিট। ক্যাপ্টেইন নিশ্চিত এখনকার খেলাই মোস্তাফিজের নর্মাল। কোচদের সংশয় অ্যাওয়েফ্রম দা উইকেট বল করায় ছন্দ হারিয়েছে দা ফিজ। শুধু কী ওটাই কারণ না আরো কিছু আছে মোস্তাফিজের চেহারা ফিরে না পাওয়ার? দেবাশীষের উত্তর,  ‘মানসিক ফিটনেসের একটা ব্যাপার থাকতেই পারে। মানসিক ফিটনেসের ব্যাপার তখনই আসবে যখন ও পারছে না। শুরুতেই তো আসেনা।’

শ্রীলঙ্কাটুরের পর আইপিএলের এক ম্যাচ।  ডেবিউতেই সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার হয়েছিলেন আইপিএলে। এবার প্রথম ম্যাচেই এমন খেললেন আর দলে নামতে পারেননি। সবার আশা ছিল ব্রিটেন সফর। আয়ারল্যান্ডে ভাল করলেও হতাশ করলেন ইংল্যান্ডে।

মাশরাফির কথায় হতাশা নেই,  নেই ভালো করার জন্য চাপাচাপি বা তাড়া, ‘জাস্ট রিসেন্ট, হয়তো-বাতিন-চারমাস, সে সেরে উঠেছে। ওর বয়সও খুব অল্প। সব দিকে তাকান, ওর সিচুয়েশনটা ভেরি ডিফিকাল্ট এখন। আমরাও যদি ওকে এখন প্রেশার করি সেটা ওর জন্য আরো কঠিন হবে।’

ডাক্তার দেবাশীষ অবশ্য মনেই করেন না মোস্তাফিজ কখনো চাপে পড়েন,  ‘আমার মনে হয় না ও পত্রিকা পড়ে বা টিভির খবর দেখে। এই ব্যাপারটা প্লাস পয়েন্ট। বাইরের কোনো আলাপ ওর কানে যায় না। তাতে এক্সট্রা প্রেসার থাকে না ওর।’

সবাই একমত মোস্তাফিজ এক বিশিষ্ট ক্রিকেটার। ইমরান ও ফাহিম দীর্ঘদিন ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত। খেলোয়াড় জীবন থেকে কোচিং। দেখেছেন অসংখ্য ক্রিকেটারের উত্থান-পতন। কিন্তু তাঁরা কি ক্রিকেট-জীবনে মোস্তাফিজের মতো মেধাবী কাউকে পেয়েছেন? এক মুহূর্ত না ভেবেই ইমরানের জবাব, ‘এমনকাউকে কোনোদিন পাইনি,  এত এক্সট্রা অর্ডিনারি বোলার আর কোনোদিন আসবে কিনা তাও বলতে পারছি না।’ ফাহিমও বলতে পারলেন না এমন কাউকে আগে পেয়েছেন।

ব্যাটসম্যানরা কত চোট জখম নিয়ে দিব্যি খেলা চালিয়ে যান। ঝামেলা যেন শুধু বোলারদের নিয়েই। তবে শরীর না মানলেও মনের জোরে খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্তও আছে। সে দাওয়াইও হাতের কাছে। চোটকে তুড়ি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার বড় ওস্তাদ মাশরাফি।  ক্যাপ্টেইনের ভরসামাখা হাতটাও মোস্তাফিজের কাঁধে।

স্বভাবে মুখচোরা মোস্তাফিজের পেট বোম মারলেও কথা বেরোয় না। ছন্দহারা অবস্থা নিয়ে তার মনের খবর জানাও দুস্কর।

সামনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই টেস্ট, আছে সাউথ আফ্রিকা সফর। টাইগার ভক্তরা চায় দুশ্চিন্তামুক্ত সচ্ছন্দ মোস্তাফিজকে, যে ক্ষণজন্মা বোলারের রানআপ শুরু হলেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়, ধুঁকতে থাকে তাবৎ ব্যাটসম্যান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত