তাহিরপুর প্রতিনিধি

২৯ মে, ২০২০ ২২:৩২

তাহিরপুরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শুল্ক স্টেশনের ৩০ হাজার শ্রমিক

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন খনি থেকে প্রতিদিন কয়লা, চুনাপাথর আমদানির মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ। এই শুল্ক স্টেশনের কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। রয়েছেন ৫ শতাধিক আমদানিকারকরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে আমদানি বন্ধ থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন আমদানিকারকরা ও শ্রমিকরা। ফলে ত্রিশ হাজার দিনমজুর শ্রমিক কর্মহীন হয়ে, তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

উপজেলা উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ভারতের মেঘালয় সীমান্ত তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই তিনটি শুল্ক বন্দর। আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুল্ক স্টেশনে কর্মব্যস্ততা থাকলেও বর্তমানে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া, বাগলী, ছাড়াগাঁও শুল্ক স্টেশনে। এই তিনটি শুল্ক স্টেশন দিয়ে দেশের চাহিদার প্রায় ৮০শতাংশই পূরণ করে ভারত থেকে আসা কয়লায়।

জানা যায়, দেশ-বিদেশের আমদানিকারকগন নিয়মিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাহিদার অনুযায়ী পাঠাতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাধ্যমে। ফলে দেশের চাহিদার অনুযায়ী বাগলী, চারাগাঁও ও বড়ছড়া শুল্ক বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০টির অধিক ট্রাক ভারত থেকে কয়লা-চুনাপাথর আনা নেওয়ার কাজ করছে কয়েক যুগ ধরে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে জেলা ও উপজেলাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দেশের অন্যান্য শুল্ক বন্দরে মত গত ২৩মার্চ থেকে, ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ৩টি (বড়ছড়া, বাগলী, ছাড়াগাঁও) শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ আছে। কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি কাজের সাথে স্থানীয় শ্রমজীবী পরিবারের আয় রোজগারের পাশাপাশি সরকারও বছরে কোটি টাকা রাজস্ব আয় করত।

কিন্তু বার বার বন্ধ হওয়া ও বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে আমদানিকারক, ব্যবসায়ীগন। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। আর সরকারও হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। ফলে শ্রমিকরা কাজে সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন। অনেকে আবার কোন উপায় না পেয়ে বৈশাখ মাসে বাহিরের জেলাগুলোতে ধান কাটার জন্যও গিয়েছেন। ধান কাটা শেষে পুনরায় এলাকায় ফিরে কর্মহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

এদিকে করোনার কারণে আমদানি বন্ধ কবে স্বাভাবিক হবে তারও নিশ্চয়তা নেই কিন্তু ওপারে (ভারতে) বাংলাদেশের অনেক আমদানিকারকের শত শত কোটি টাকার কয়লা আটকা পড়ে আছে।

মাসুক মিয়া, শফিকুল ইসলামসহ সচেতন মহল জানান, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের অর্থনীতিতে তাহিরপুর উপজেলার ৩টি শুল্ক বন্দরের রয়েছে অনস্বীকার্য ভূমিকা। যার প্রভাব পড়ে পুরো জেলার অর্থনীতিতে। করোনাভাইরাস জনজীবনে মহামারি আকার ধারণ করেছে। যার কারণে তিনটি শুল্ক বন্দরের চারপাশে সুনসান-নিস্তব্ধতা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিকর।

জেনি এন্টারপ্রাইজে স্বত্বাধিকারী জুনাব আলী আহমেদ জানান, শুল্ক বন্দরগুলো কিছু দিন পর পরেই বন্ধ হয়ে যায়, আর এভাবেই চলছে গত ৬বছর ধরে। কবে স্বাভাবিক হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। এখন বন্ধ করোনার কারণে। কয়লা আমদানি করতে না পারলেও এলসির সুদ ব্যাংককে ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে এখন কয়লা দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এলসির মাধ্যমে আমদানি করার জন্য শত শত কোটি টাকার কয়লা আটকা আছে এদেশিও ব্যবসায়ীদের। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সব মিলিয়ে ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা।

বড়ছড়া শুল্ক বন্দরের শ্রমিক রুকন মিয়াসহ অনেকেই জানান, কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় কাজের সন্ধানে অনেকেই শহরমুখী হচ্ছেন। আর যারা এখনও বন্দর খোলার আশায় বাড়িতে আছেন তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

তাহিরপুর কয়লা আমদানি কারক গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের জানান,আমদানিকারকরা অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে দুশ্চিন্তা আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।

তিনি বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়জনিত অভিযোগ এনে ২০১৪ সালে মেঘালয় উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করে ভারতীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি)। এর পরেই উপজেলার এ ৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা আমদানি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। শুধুই চুনাপাথর আমদানি হয়। এরপর ২০১৫ সাল থেকে আলোচনা সাপেক্ষে কখনো দু মাস আবার কখনো চার মাস আবার ৬ মাস কয়লা আমদানি কার্যক্রম শুরু করে চলে চলতি বছরের ২৩ মার্চ পর্যন্ত। করোনার কারণে
আমদানি বন্ধ হওয়ায় অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোণ নিয়ে বিনিয়োগ করে এখন ক্ষতির মুখে রয়েছেন। এছাড়াও আমদানি কার্যক্রমের সাথে জড়িত সকল শ্রমিকরাও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি আলখাছ উদ্দিন খন্দকার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে উপজেলার তিনটি শুল্ক বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি করতে না পারায়, ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এছাড়াও বার বার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বন্দরগুলো পুনরায় চালুর হলে আমদানিকারক, ব্যবসায়ীসহ এর সাথে জড়িত সকল শ্রমজীবীদের জীবন যাপন স্বাভাবিক হবে। না হলে কষ্টের শেষ থাকবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত