কমলগঞ্জ প্রতিনিধি

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৭:৫৬

কমলগঞ্জে টমেটো চারার নার্সারি করে কোটিপতি কৃষক

এক সময়ের বৃহত্তর সিলেটের শস্যভাণ্ডার খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা শান্তিতে জাতিসংঘ পদকপ্রাপ্ত সাবেক সেনা সদস্য এম এ করিমের (৫৫) বাড়ি। চাকরির সময়সীমা পার হওয়ার পর অবসরে যান তিনি। কিন্তু কাজ থেকে তিনি অবসর নেননি। কারণ তিনি একজন সফল ‘ড্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটোর চারা উৎপাদক’। এক সময় এম এ করিম নিজে একাই ড্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটোর চারা উৎপাদন করা শুরু করেছিলেন, এখন তিনি নিজে স্বাবলম্বিতো হয়েছেন, করেছেন দু’শত মানুষের কর্মসংস্থানও।

এ বছর তিনি ৫বিঘা জমিতে করেছিলেন ড্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটোর চারার নার্সারি। কোটি টাকার উপড়ে আয়ও করেছেন এই নার্সারি থেকে। সরেজমিনে আলাপকালে এমনই জানালেন এম এ করিম নিজেই।

ড্রাফটিং পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এম এ করিম জানান, বনবেগুন হচ্ছে টমেটোর একটি জংলি জাত, গ্রাম-গঞ্জে এ বেগুনের হরেক নাম। এই বেগুন চারার গোড়ার দিকের অংশের সঙ্গে টমেটোর চারার ওপরের দিকের অংশ জোড়া দিয়ে করা হয় ড্রাফটিং। এভাবে লাগানো টমেটোর চারা বড় হয়ে ঢলে পড়ে না, রোগবালাইও তেমন হয় না। উপরন্তু ফলন মেলে প্রচুর। যেখানে সাধারণ একটি গাছে পাঁচ-দশ কেজি টমেটো মেলে, সেখানে ড্রাফটিং করা প্রতি গাছে মেলে বিশ থেকে পঁচিশ কেজি।

তিনি জানান, ড্রাফটিং করা টমেটো গাছ পানি সহনীয়। তাই ভারী বৃষ্টিতেও এই টমেটোগাছ নষ্ট হয় না। ‘ড্রাফটিং চারার চাহিদা অনেক। নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের আরও আট থেকে দশটি জেলায় সরবরাহ করে থাকি। অনেকে মৌসুমের আগেই চারার সংখ্যা জানিয়ে অর্ডার দেন। তাদেরকে সময়মতো সরবরাহ করতে হিমশিম খাই।

তিনি বলেন, অনেকে আষাঢ়-শ্রাবণ থেকে চারা রোপণ শুরু করেন। আগাম টমেটো বের করতে পারলে লাভ বেশি। তখন কেজিপ্রতি টমেটো ১০০-১১০ টাকা বিক্রি হয়।

কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামে প্রায় অর্ধশত কৃষক আছেন যারা এম এ করিমের ড্রাফটিং করা চারা ব্যবহার করে টমেটোর চাষ করছেন। এম এ করিম নিজেও এ বছর সীমান্তবর্তী দলই চা বাগান এলাকায় প্রায় ২১ বিঘা জমিতে ড্রাফটিং পদ্ধতির চারা দিয়ে টমেটোর চাষ করেছেন। ক্ষেতে টমেটোও ধরেছে, এর মধ্যেই টমেটো পাঁকতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি জালালপুর গ্রামে ঢুকেই বিভিন্ন জাতের সবজি ও টমেটো চাষের নমুনা দেখা গেল। গ্রামের খানিকটা ভেতরে গিয়ে চোখে পড়ল এ বাড়ির উঠান, ওবাড়ির উঠান, বাড়ির পাশে খালি জমিতে বাঁশ ও পলিথিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি তাঁবু। এগুলো ড্রাফটিং চারা তৈরির অস্থায়ী ঘর। রোদ-বৃষ্টি থেকে চারা বাঁচাতে এ ব্যবস্থা। এম এ করিমের নিজ জমিতেও কয়েকটি তাঁবু দেখা গেল। তবে বেশির ভাগ তাঁবু চারাশূন্য। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, এখন চারা রোপণের শেষ সময় বলে অধিকাংশ চারাই বিক্রি হয়ে গেছে। এরপরও একটি তাঁবুতে চারা ড্রাফটিংয়ের কাজ করছিলেন পাঁচজন, তারা শ্রমিক। এম এ করিমের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন তারা নিয়মিত ড্রাফটিংয়ের টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন।

তিনি জানান, এ বছর তিনি ২০ লাখ চারার ড্রাফটিং করেছেন। বারি-৮ (বাংলাদেশী), মঙ্গল রাজা (ফ্রান্স) নামে টমেটোর বীজ এবং বনবেগুণের বীজ বুনেছিলেন। বনবেগুণের দুই মাস বয়সী চারার সঙ্গে টমেটোর এক মাস বয়সী চারার ড্রাফটিং করেছেন। ড্রাফটিং করা চারা ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে রোপণ করতে হয়। প্রতিটি চারা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করেছেন। ড্রাফটিংয়ের কাজে নিজে সার্বক্ষণিক শ্রম দিয়েছেন। তার সঙ্গে নিয়মিত খেটেছেন প্রায় ১৫০ জন দক্ষ শ্রমিক। তাদের মাসিক ২০-২৫ হাজার টাকা ইনকাম।

তার এভাবে চারা উৎপাদন করতে বিনিয়োগ হয়েছে সীমিত। এ বছর প্রায় ২০ লক্ষ চারা বিক্রি করেছেন, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। এতে এ মৌসুমে চারা বিক্রি থেকে ব্যাপক লাভ করেছেন । ট্রাকযোগে চারা নিয়ে গেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষকেরা। এ ছাড়া কৃষকেরাও তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহের পাশাপাশি নিয়মিত পরামর্শ নিচ্ছেন বলে জানান এম এ করিম।

‘অসময়ের টমেটো চাষি’ খ্যাত এম এ করিম সম্পর্কে জানতে চাইলে কমলগঞ্জের জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা টমেটো চাষি মোতালেব ব্যক্ত বলেন, এম এ করিম সেনা সদস্য ছিলেন। আদতে তিনি একজন উদ্ভাবনী কৃষক। নানা ফসল নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। টমেটোর এই ড্রাফটিং প্রযুক্তি তার কারণে সহজেই এলাকার সাধারণ কৃষকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। নিজে লাভবান হয়ে এলাকার কৃষকদের বিরতিহীনভাবে পরামর্শ দিয়ে চলছেন মানুষটি।

সাবেক এ সেনা সদস্য ২০০২ সালে অবসরে এসে টমেটো চাষ শুরু করলে উৎপাদনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। টমেটো চাষে সফল চাষি হিসেবে তিনি ২০০৫ সালে পেয়েছেন জাতীয় কৃষি পুরষ্কার। পুরষ্কারটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তখন তার হাতে তোলে দেন। এরপর থেকে এই উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন তিনি সফল কৃষক।

আলাপকালে সফল টমেটো চাষি এম এ করিম একরকম অভিযোগ করেই বলেন, সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ যদি আরও আন্তরিক হতো, তবে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা কৃষিতে আরও বিপ্লব ঘটাতে পারতো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। কিন্তু ৮০ ভাগ কৃষি নির্ভর এ দেশে কৃষিতে সরকার কৃষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করে না, যা খুবই দুঃখজনক। অন্যান্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। আর কৃষিতে দেওয়া হয় ৫-৬ হাজার টাকার পুরস্কার। এজন্যেই কৃষকেরা কৃষিতে উৎসাহ পায় না। সরকার যদি কৃষিকে আরও গুরুত্ব দেয়, তবে দেশ কৃষিতে আরও এগিয়ে যাবে এমনটাই মনে করেন কৃষক এম এ করিম।

এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, এম এ করিম একজন সফল ‘ড্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটোর চারা উৎপাদক’। এখন তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অনেক লোকের কর্ম-সংস্থানও করেছেন। কমলগঞ্জে এম এ করিমের মত আরও অর্ধশতাধিক কৃষক টমেটোর ড্রাফটিং করে স্বাবলম্বী হয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত