নিজস্ব প্রতিবেদক

১৬ মে, ২০২১ ০১:৫৯

ঈদেও আনন্দ নেই তাদের

‘এক বছরে চার মাস বেতন পেয়েছি, আমাদের কিসের ঈদ’

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন। সিলেট নগরের একটি হোটেলের বিপনন বিভাগে কাজ করতেন। ২০১৩ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হলে বন্ধ হয়ে যায় কুতুবদের হোটেল। সেই থেকেই অবৈতনিক কর্মীতে পরিণত হন তিনি। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে গত অক্টোবরে হোটেল থেকে আবার ডাক পড়ে তার। এইবছর মার্চ থেকে আবার লকডাউন। আবার চাকিরীহীন কুতুব উদ্দিন। এই ঈদেও বেতন-বোনাস পাননি তিনি। ফলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে পড়েছেনর বিপাকে।

কুতুব উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, গত একবছরের বেশি সময়ে চারমাসের মতো বেতন পেয়েছি। বাকীটা সময় চাকরিহীন হিসেবে বাড়িতে বসে আছি।  এই অবস্থায় আমাদের কিসের ঈদ। বেঁচে থাকা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে।

নগরের জিন্দাবাজার এলাকার আরেকটি হোটেলে অভ্যর্থনাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন সুনামগঞ্জ দিরাই উপজেলার বাসিন্দা সবুজ আহমদ। গত এপ্রিল থেকে তাকে অবনৈতিকভাবে ছুটিতে পাঠিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। মার্চের বেতন পেলেও এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। মিলেনি ঈদ বোনাসও।

সবুজ বলেন, হোটেল কর্তৃপক্ষ অন্য চাকরি খোঁজার জন্য বলে দিয়েছে। এই অবস্থায় আমি নতুন চাকরি কোথায় পাবো? এই দুশ্চিন্তায়ই দিন যাচ্ছে। ঈদের আনন্দ বলতে আমাদের পরিবারে কিছু নেই। গত তিনটি ঈদই এরকম কেটেছে।

কেবল কুতুব উদ্দিন বা সবুজ আহমদই নয়, একইরকম অবস্থা সিলেটের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের বেশিরভাগ কর্মীদেরই। এই খাতের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মীদের অবৈতনিকভাবে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত মাসের বেতন ও ঈদের বোনাস পাননি বেশিরভাগ কর্মীই। ফলে আনন্দের ঈদও তাদের জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। বরং চাকরি নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তারা।

গত এক যুগে সিলেটে পর্যটনখাত ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মানুষজনের মধ্যে ঘুরার প্রবণতা বাড়ার কারণে সিলেটে বেড়েছে পর্যটক সমাগম। ফলে সিলেটজুড়ে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। এগুলো ব্যবসাও হচ্ছিলো ভালো। পর্যটনখাতকে সিলেটের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত মনে করা হতো। দুই ঈদ সহ বিভিন্ন ছুটির সময়ে সিলেটে পর্যটকদের ঢল নামতো। ফলে কোনো হোটেল-রিসোর্টেই কক্ষ খালি পাওয়া যেতো না।

তবে করোনাভাইরাস নামক অচমকা এক ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাতই এখন পড়েছে সবচেয়ে সঙ্কটে। করোন্রা কারণে গত তিন ঈদেই  বন্ধ ছিলো হোটেল-রিসোর্টগুলো। বন্ধ ছিলো গত একবছরের বেশিরভাগ সময়ই। ফলে নজিরবিহীন সঙ্কটে পড়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। আর চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন কর্মীরা।

সিলেট জেলায় হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে দুই শতাধিক। এতে লক্ষাধিক কর্মী কর্মরত ছিলেন। তবে এসব কর্মীদের বেশিরভাগকেই ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছুটিতে যাওয়া কর্মীরা বেতনও পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে পেশাও বদলে নিয়েছেন তাদের অনেকে।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকার বাসিন্দা কয়েস উদ্দিন। সিলেটের একটি হোটেলের হিসাব শাখায় কাজ করতেন। চাকরি হারিয়ে তিনি কৃষিকাজ শুরু করেছেন।

কয়েস বলেন, নিজেদের কিছু জমি ছিলো। এগুলো আগে বর্গা দিয়ে চাষ করাতাম। এবার নিজেই চাষ করেছি। নিজের জমিগুলো না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো, মন্তব্য কয়েসের।

নগরের জিন্দাবাজার এলাকার গোল্ডেন সিটি হোটেলের মহাব্যবস্থাপক মিষ্ঠু দত্ত বলেন, আমাদের হোটেলে প্রায় ৫০ জন কর্মী ছিলেন। তাদের গত ১ মে থেকে ছুৃটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য কোথাও চাকরি পেলে তাতে যুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্যও তাদের বলে দেওয়া হয়েছে।

মিষ্ঠু বলেন, এপ্রিল পর্যন্ত আমরা কর্মীদের বেতন দিয়েছি। কিন্তু এখন আর বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ মার্চ থেকেই আমাদের ব্যবসা বন্ধ। দিনের পর দিন হোটেল বন্ধ রেখে কর্মীদের বেতন দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না।

শনিবার সিলেট নগরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরের অনেক হোটেলের মূল ফটকে তালা ঝুলছে। আবার কিছু হোটেলের ফটক খোলা থাকলেও ভেতরে কোনো অতিথি নেই। দেখভালের জন্য দুএকজন কর্মী ছাড়া সবগুলো হোটেলই প্রায় ফাঁকা।

সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এই সংগঠনের সদস্যভুক্ত হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে ৩৪টি। লকডাউনের কারণে সবগুলোই সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

তবে শনিবার বিকেলে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান, বিমানবন্দর সড়ক, তারাপুর চা বাগানসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভিড় করেছেন বিনোদনপ্রেমীরা। চা বাগানের ভেতরে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন অনেকে।

সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুমাত নুরী জুয়েল বলেন, ঈদ মৌসুমে আমাদের ব্যবসা সবচেয়ে ভালো হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন। অথচ গত তিনটি ঈদের সবগুলো হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ ছিলো।

তিনি বলেন, গত বছর লকডাউনে বন্ধের ক্ষতিই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একটু একটু করে যখন ব্যবসা জমে ওঠছিলো খন আবার লকডাউন দেওয়া হলো। এমন অবস্থায় আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে ওঠেছে। ফলে এই খাতের কর্মীরাও সঙ্কটে পড়েছেন।

তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের সদস্যভ’ক্ত সকল হোটেল রিসোর্টই কর্মীদের ঈদের আগে বেতন ও বোনাস প্রদান করেছে। তবে এই সঙ্কট অব্যাহত থাকলে বেতন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত