নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ নভেম্বর, ২০২১ ০১:২২

সিলেটে কেন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি?

সিলেটে ৭৭ ইউপির ৪৬টিতেই আ.লীগের হার

দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সিলেটে আওয়ামী লীগের অবস্থা আরও শোচনীয়। রোববার সিলেটের ৭৭ ইউনিয়নে ভোট হয়। এর মধ্যে ৪৬টিতেই হেরেছেন নৌকার প্রার্থীরা। ৩১টিতে জয়ী হয়েছে নৌকা। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী হওয়া ২০ জন প্রার্থী জয় পেয়েছেন।

বিশেষত নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগের অবস্থা বেশি খারাপ। সুনামগঞ্জে ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দুটিতে জিতেছে আওয়ামী লীগ। আর হবিগঞ্জে ২১ ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৮টিতে জয়ী হয়েছেন নৌকার কান্ডারিরা।

বিদ্রোহী প্রার্থী, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ও দলীয় বিরোধের কারণেই এমন ফল হয়েছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

তৃতীয় ধাপে সিলেটে ১৬টি, সুনামগঞ্জে ১৭, মৌলভীবাজারের ২৩ এবং হবিগঞ্জ ২১টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়। এসব ইউনিয়নে বেশির ভাগে বিদ্রোহীকে দমাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সিলেট জেলায় ১৪ জন, সুনামগঞ্জে ২৮, মৌলভীবাজারে ২৪ এবং হবিগঞ্জে ১৮ জন মিলিয়ে দলটির ৮৪ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফখরুল ইসলাম শায়েস্তা। এই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তবে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় অপেক্ষাকৃত তরুণ ছদরুল ইসলামকে। বিদ্রোহী প্রার্থী হন শায়েস্তা। দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তবে রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পান শায়েস্তা।

দক্ষিণ সুরমা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে শায়েস্তার। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি হাবিববিরোধী বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। এ কারণে জনপ্রিয়তা ও ক্লিন ইমেজ থাকা সত্ত্বেও শায়েস্তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তবে ভোটের মাঠে শাস্তেয়ার সঙ্গে পাত্তা পাননি কেউ।

যেসব ইউনিয়নে বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন তার বেশির ভাগেরই হিসাব এমন। স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ আর অর্থের কাছে মনোনয়নবঞ্চিত হন তারা। তবে ভোটে মাঠে দমিয়ে রাখা যায়নি তাদের।

সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতদের ধারণা, প্রার্থী বাছাই ভালো হলে ও দলীয় বিরোধ মেটাতে পারলে তৃতীয় ধাপে ৭৭টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অন্তত ৫০টিতে সহজেই জয় পেতে পারতেন। তারা বলছেন, সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত্তি তেমন মজবুত নয়। এবার নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি ছিল না। ফলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ ছিল এই নির্বাচনে।

প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে সিলেটের কোনো ইউনিয়ন পরিষদ ছিল না। গত ১১ নভেম্বর দেশে দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিলেটের ৪৪টি ইউনিয়নও ছিল। এর মধ্যে একটি ইউনিয়নে ফল স্থগিত হয়। বাকি ৪৩টির মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ১৯টিতে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয় পান ১০টিতে। বাকিগুলোর মধ্যে একটিতে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী, দুটিতে জামায়াতের প্রার্থী এবং ১১টিতে বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন।

দ্বিতীয় ধাপের ওই নির্বাচনে বেশির ভাগ ইউপিতে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের পর তৃতীয় ধাপে আরও আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ ধাপেও দমানো যায়নি বিদ্রোহীদের, সিংহভাগ ইউপিতে পরাজয় মানতে হয়েছে দলীয় প্রার্থীদের।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ মিলিয়ে সিলেট বিভাগের ১২০টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৫০টিতে। দলটির বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন ৩০টি ইউনিয়নে।

তৃতীয় ধাপের ফলাফল বলছে, সিলেট জেলার ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে আওয়ামী লীগ, ৩টিতে দলটির বিদ্রোহী, ২টিতে স্বতন্ত্রের মোড়কে বিএনপি, একটিতে জাতীয় পার্টি ও একটিতে জাসদের প্রার্থী জয় পেয়েছেন।

সুনামগঞ্জের ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দুটিতে জয় পেয়েছে নৌকা প্রতীক। পাঁচটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, দুটিতে জাতীয় পার্টি, একটিতে জমিয়ত ও ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ীর হাসি হেসেছেন।

মৌলভীবাজারের ২৩টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে ১২টিতে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা ৭টিতে, স্বতন্ত্র থেকে বিএনপি নেতারা দুটিতে এবং অপর দুটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

হবিগঞ্জের ২১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টিতে নৌকা প্রতীক জয় পেয়েছে। পাঁচটিতে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। বাকিগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।

এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু বিরোধ থাকেই। এসব কারণে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমানো যায় না। তবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি।’

প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রার্থী তিন ধাপে বাছাই হয়েছে। তৃণমূলের পর জেলা কমিটি। এরপর কেন্দ্র। অনেক কিছু বিবেচনা করেই প্রার্থী দেয়া হয়েছে। ফলে ভুল হওয়ার সুযোগ কম।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত