নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ জুন, ২০২৩ ০০:৪০

পা হারানো এক নৌকা-অন্তঃপ্রাণের গল্প

একটা পা নেই। হাঁটতে হয় স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে। নিজের স্বাভাবিক চলাফেরাতেই সমস্যা। নিজের প্রয়োজনীয়তাই সম্পাদনে নিতে হয় অন্যের সাহায্য। কিন্তু নির্বাচন এলেই যেন ভর করে অন্য শক্তি। বেমালুম ভুলে যান নিজের শারীরিক অসামর্থ্যের কথাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা কিংবা দলবদ্ধভাবে চালিয়ে যান নিজের প্রিয় দলের প্রচারণা।

এটা তেমনই এক আওয়ামী লীগ-ভক্ত কিংবা নৌকা-অন্তঃপ্রাণের গল্প। নাম ফয়সল আহমদ মালিক।

বাড়ি ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে। ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন প্রবাসী। বাহরাইন যুবলীগ মানামা শাখার সহসভাপতি ছিলেন তিনি।

২০১৬ সালে তিন মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। ছুটি কাটছিল ভালোভাবেই, কিন্তু ফেরত যাওয়ার দিন তিনেক আগে তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর স্বজনদের হামলায় আহত হন তিনি। সিলেটে চিকিৎসার পর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার এক পর্যায়ে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়।

তিনি আওয়ামী যুবলীগের রাজনীতি করলেও যারা আক্রমণ করেছিল তারাও আওয়ামী লীগের। তার ভাষায়, ওরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। নির্বাচনে বিরোধিতা করেছেন এই অজুহাতে তার ওপর হামলা করে তাকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করার পর এখন চালাচ্ছে আপসের চেষ্টা। বিচারের দাবিতে বারবার ঘুরেছেন নানা জায়গায়, কিন্তু সেই বিচার এখনো অসমাপ্ত।

আদালতের এ দ্বার, ও দ্বার ঘুরতে-ঘুরতে এখন নিঃস্ব-প্রায় ফয়সল আহমদ মালিক। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছেন।

পা হারানো সেই মালিক তবু অদম্য। বলা যায় নৌকা-অন্তঃপ্রাণ। সদ্য সমাপ্ত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে নৌকা মার্কার সমর্থনে প্রচারণা চালান। লিফলেট বিতরণ করতে ওসমানীনগর থেকে প্রায়ই আসতেন সিলেটে। অংশ নিয়েছেন পথসভায়, সমাবেশে, ঘরে-ঘরে প্রচারণায়।

স্ক্র্যাচে ভর করে নৌকা প্রতীকের প্রচারণা চালানো ফয়সল আহমদ মালিকের একটি ভিডিও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও শেয়ার করা হয়েছে। তিনি কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন। নেতারা প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। তবু স্বপ্ন দেখেন একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ পাবেন।

শারীরিক এমন অবস্থায়ও কেন নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নিলেন এমন প্রশ্নের জবাব ফয়সল আহমদ মালিক বলেন, ‘‘আমি হামলার শিকার হয়ে সুস্থ হওয়ার পর আনোয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি কিছুটা সহযোগিতা করেছিলেন। আর যখন সিটি নির্বাচন আসল, তখন নিজ উদ্যোগে নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান চৌধুরী নাজলুর সঙ্গে সিলেটে যাই। পৃথক ৪ দিন মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষে ভোট চেয়েছি। তবে তার সাথে (আনোয়ারুজ্জামান) দেখা করিনি। ফোনও করিনি।

তিনি বলেন, ‘‘ নৌকা আর আওয়ামী লীগ আমার রক্তে। শেখ হাসিনা নৌকার মনোনয়ন দিয়েছেন। তাকে জয়ী করতে মাঠে তার পক্ষে ভোট চাওয়া একটা দায়িত্ব মনে করেছি। যখন কাজ করেছি তখন শরীরের কষ্টটা বুঝতে পারিনি। আলাদা একটা টান কাজ করে। দলের প্রতি ভালোবাসাই আমাকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শেষ পর্যন্ত আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জয়ী হয়েছেন। একটা তৃপ্তি কাজ করছে।’’

‘‘আমি চেষ্টা করি সব সময় দলের জন্য কাজ করতে। তবে শরীরের জন্য পারি না। তারপরও ওসমানীনগরে দলের সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করি।’’

তার ওপর হামলার ঘটনায় মামলার অবস্থা কী, এ প্রসঙ্গে ফয়সল আহমদ মালিক বলেন, ‘‘হামলার পর ওসমানীনগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা সহযোগিতা করেছেন। তারা এখনও আমাকে মূল্যায়ন করেন। মামলায় অভিযুক্তরা জামিনে আছেন। বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আপস করার চেষ্টা করছেন।’’

বর্তমানে কেমন আছেন, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পা হারানোর পর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হই। জীবিকার দায় মেটাতে বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান দিয়েছি। কোনোমতে চলছি। এছাড়া বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা মাঝেমধ্যে সহযোগিতায় করেন। শারীরিকভাবে মোটামুটি ভালো আছি।’’

ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান চৌধুরী নাজলু বলেন, ‘‘ফয়সল দলের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী। সিলেটে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার ভাইয়ের পক্ষে যখন আমরা কাজ করছি, তখন সে (ফয়সল) স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে প্রচারণায় যাওয়ার জন্য বলেছে। একটি গাড়ি সে রিজার্ভ করে অংশ নিয়েছে কয়েকদিন প্রচারণায়। তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সে বুঝতে দেয়নি। বৃষ্টির মাঝে মানুষের কাছে দলের প্রার্থীর জন্য ভোট চেয়েছে।’’

‘‘ফয়সল তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও উপজেলায় আওয়ামী লীগের সকল অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। তার এই অংশগ্রহণ দলের নেতাকর্মীদের জন্য প্রেরণার।’’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত