নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ মার্চ, ২০২৪ ০১:৩৯

হরিষে বিষাদ

তিন সপ্তাহ আগে বিয়ে হয় অনামিকা পাত্রের। রীতি অনুযায়ী বাবার বাড়ির লোকজনকে মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ে অনামিকার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিমকি, নাড়ুসহ নানা পদের ২০ কেজি মিষ্টি কেনা হয়েছিল। সোমবার ছিল জলপান অনুষ্ঠান।

কিন্তু অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় সেই অনুষ্ঠান আর হয়নি। দুর্ঘটনায় অনামিকার মা, ভাবি, ভাতিজিসহ ছয়জন নিহত হন। সেই জলপানের মিষ্টি পড়ে আছে ঘরে। দুর্ঘটনায় নিহত সবার বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের পশ্চিম ঠাকুরের মাটি গ্রামে।

মঙ্গলবার দুপুরে ওই গ্রামে গেলে অনামিকার মামাতো ভাই সুগ্রিব পাত্র জলপানের মিষ্টিগুলো দেখাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, মিষ্টিগুলো বোনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পর সেগুলো ফেরত আনা হয়। তাদের বাড়িতে রাখা হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটবে কল্পনাও করতে পারেননি কেউ।

সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক সড়কের দরবস্ত পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের সামনে লেগুনা ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন- জৈন্তাপুরের পশ্চিম ঠাকুরের মাটি গ্রামের সন্তোষ পাত্রের স্ত্রী মঙ্গলী পাত্র (৫০), পুত্রবধূ সুচিত্রা পাত্র (৩০), নাতনি বিজলী পাত্র (৬ মাস), একই গ্রামের নন্দ পাত্রের স্ত্রী সাবিত্রী পাত্র (৩৫), সুবেন্দ্র পাত্রের মেয়ে ঋতু পাত্র (৮) ও নৃপেন্দ্র পাত্রের স্ত্রী শ্যামলা পাত্র (৫৫)।

মঙ্গলবার দুপুরে নিহত মঙ্গলী পাত্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, টিলার মতো উঁচু জায়গায় আধাপাকা একটি বাড়ি। বাড়ির ভেতরে কয়েকটি শিশু খেলা করছে এবং টিভি দেখছে। শিশুদের মধ্যে তিন–চার বয়সী এক শিশুর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। বাড়িতে পাড়া–প্রতিবেশীরা আসা–যাওয়া করছেন। কিছুক্ষণ পরপর ব্যান্ডেজ দেওয়া শিশু ও সাত-আট বছর বয়সী আরেক শিশুর ডাক পড়ছে। মুরব্বিদের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা এসে আবার চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের ডাক পড়ার কারণ এখনো তারা সেভাবে জানে না।

শিশু দুটির একজন জিদান পাত্র (৪) ও অন্যজন তৃষ্ণা পাত্র (৮)। দুই শিশুর মা সুচিত্রা, বোন বিজলী ও দাদি মঙ্গলী পাত্র দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তাদের বাবা কুশ পাত্র (৩২) চিকিৎসাধীন। দুর্ঘটনার শিকার গাড়িতে জিদান ও তৃষ্ণা ছিল। জিদানের মাথা কেটে গেছে। এ জন্য মাথায় ব্যান্ডেজ দেওয়া। আর তৃষ্ণা সামান্য আঘাত পেয়েছে।

নিহত মঙ্গলীর মেজ ছেলে লব পাত্র বলেন, মা-দাদি ও বোন মারা গেছে, এখনো জানে না জিদান ও তৃষ্ণা। তারা জানে, মা ও দাদি ছোট বোনকে নিয়ে বেড়াতে গেছে। গতকাল গাড়িতে তারাও ছিল। দুর্ঘটনার পর তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আজ সকালে মুঠোফোনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। বাবা তাদের বলেছেন, কাজে বাইরে আছেন। ফেরার সময় তাদের জন্য বিস্কুট নিয়ে আসবেন। মা–দাদি গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরবেন। এ জন্য মায়ের পথ চেয়ে আছে দুই ভাই-বোন।

তিনি বলেন, জিদান ও তৃষ্ণা ঘটনার কিছুই জানে না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী বাড়িতে আসছেন। দুই ছেলেমেয়েকে দেখতে চাইছেন। এ জন্য বারবার তাদের ডাক পড়ছে।

স্বজনেরা জানান, ভিটেমাটি ছাড়া তাদের তেমন কিছুই নেই। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় দুই ভাই ও বোনদের বিয়ে হয়েছে। ২০-২২ দিন ছোট বোন অনামিকার বিয়ে হয়। রীতি অনুযায়ী সোমবার স্বজনদের নিয়ে মেয়ের শ্বশুরের বাড়িতে জলপান অনুষ্ঠান ছিল। সেই জলপান অনুষ্ঠানেই যাচ্ছিলেন। পাঁচটি লেগুনা নিয়ে গ্রাম থেকে ৫০-৬০ জন আত্মীয়স্বজন যাচ্ছিলেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পাঁচটি লেগুনার মধ্যে একটির সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক সড়কে পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। নিহত ছয়জনকে সোমবার রাতে সৎকার করা হয়।

মামলা হলেও গ্রেপ্তার নেই

এ ঘটনায় সিলেটের তামাবিল হাইওয়ে পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার সকালে জৈন্তাপুর থানায় একটি মামলা করেছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া লেগুনা ও পিকআপ ভ্যান জব্দ দেখানো হয়েছে।

তবে মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত