২৮ জুলাই, ২০২৫ ২৩:৩০
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং। ফাইল ছবি
পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হওয়ায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকা জাফলং থেকে পাথর ও উত্তোলন বন্ধ করে সরকার। তখন থেকে এখানকার কোয়ারি ইজারা দেওয়াও বন্ধ করা হয়। তবু বন্ধ ছিলো না পাথর উত্তোলন।
তখন রাতের আঁধারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন অবৈধভাবে পাথর লুট করা হতো। গতবছরের ৫ আগস্ট গণভ্যুথানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু জাফলংয়ের লুটপাট থামেনি। বরং ৫ আগস্টের পর তা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এখনও লুটপাটের নেপথ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা।
৫ আগস্টের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সুযোগে জাফলংয়ে অবাধে শুরু পাথর লুট। এখন আর রাতের আঁধারে নয়, দিনেই চলে লুটপাট। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসন কিছু সক্রিয় হলেও লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের উপদেষ্টাদেরও জাফলংয়ে গিয়ে পাথর লুটেরাদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে।
আর গত শনিবারই (২৬ জুলাই) পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, গত চার বছর পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে পেরেছিলাম। এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না। পাথর উত্তোলনে সর্বদলীয় ঐক্য দেখলাম।
অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে গত ১০ মাসে কেবল জাফলং থেকেই ৫০০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। লুটপাটের ফলে এখন পাথরহীন হয়ে পড়েছে জাফলং। সৌন্দর্য হারিয়েছে দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণীয় এই এলাকা।
গত রোববারও (২৭ জুলাই) জাফলংয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বালু মিশ্রিত পাথরবোঝাই ৫০ নৌকা ধ্বংস ও ৫টি ট্রাক বালু জব্দ করা হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে।
এখন প্রায় নিয়মতিই জাফলংয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবু লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষা আমরা (ধরা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, আওয়ামী লীগের সময়েও জাফলংয়ে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। তবে শেষ সময়ে জাফলংয়ের পাথর উত্তোলন বন্ধ করে লুটপাটের কিছুটা লাগাম টানতে পেরেছিলো তৎকালীন সরকার। এতে নদীতে পাথর জমা হয়ে জাফলংয়ের সৌন্দর্য অনেকটা ফিরে আসছিলো। প্রকৃতির ধ্বংসলীলা কিছুটা কমেছিলো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সর্বনাশ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন,, গত দেড় দশকে সিলেটে যে পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লুটপাট হয়েছে গত ১১ মাসের ব্যবধানে। এ নজিরবিহীন লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ।
জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই জাফলং পাথর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন শুরু করেন। ইজারা স্থগিত থাকলেও রাতদিন বোমা মেশিন ও এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাথর তোলা থেমে নেই।
পাথর লুটের অভিযোগে ইতোমধ্যে একাধিক নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। মামলা-গ্রেপ্তার করেও ঠেকানো যাচ্ছে না লুটপাট।
৫ আগস্টের পর শুরুতে জাফলং কোয়ারি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ওঠে সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত গোয়াইনঘাটের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনসহ যুবদল ও ছাত্রদল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
জাফলংয়ে বালু-পাথর লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে গতবছরের ১৪ অক্টোবর রফিকুল ইসলাম শাহপরানের দলীয় পদ স্থগিত করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। ৯ জুন জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেমকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় যুবদল।
তবে লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বহিস্কৃত বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান বলেন, আমি বালু ও পাথর উত্তোলনের সাথে সম্পৃক্ত নেই। তবে আমার নিজস্ব জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করছি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের ঘটনায় ৯টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২২৬ জনকে। এর মধ্যে জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম গত ২৭ এপ্রিল সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তবে গত ঈদের আগে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার মো. তোফায়েল আহমদ বলেন, গোয়াইনঘাটে দায়ের হওয়া ৯টি মামলার অন্তত ৯০ শতাংশ আসামিই জামিনে আছেন। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, বালু-পাথর লুট বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। একাধিক মামলাও হয়েছে। তবু তাদের থামানো সম্ভব হচ্ছে না।
গত ১৪ জুন সরকারের দুই উপদেষ্টা জাফলংয়ে পরিদর্শনে গেলে তাদের গাড়িবহরে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ভিডিও ফুটেজে যুবদল, ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের একাধিক নেতাকেই ঘটনাস্থলে দেখা যায়।
১৪ জুন দুপুরে জাফলংয়ের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) পরিদর্শনে যান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা শেষে ফেরার পথে স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে একদল মানুষ পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে উপদেষ্টাদের গাড়িবহরের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেন।
এ বিক্ষোভে নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সুমন শিকদার, গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান, জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল জলিল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম ও ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রমজান মোল্লা। এই ঘটনার পর ওই রাতে গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় আর পরদিন আজির উদ্দিনকে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করে ছাত্রদল।
এরপর গত ১৫ জুন রাতে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে ও প্রায় ১৫০ জনের নাম অজ্ঞাত রেখে মামলা করে পুলিশ। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান, দ্বিতীয় আসামি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন। এ ছাড়া মামলায় আরও সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারাও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত।
মামলা দায়েরের দিনই জাফলং ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, শ্রমিকদল নেতা শাহজাহান আহমদ ও ফারুক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের পাশাপাশি প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণেও পাথর লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার।
তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষ পাথর কোয়ারি আর নদ-নদী থেকে নির্বিচার পাথর লুটপাট করছেন। অথচ প্রশাসন তা ঠেকাতে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না।
গত ১০ মাসে কী পরিমাণ পাথর লুট এর কোন পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, নিয়মিত অভিযানসহ প্রশাসনের নানা উদ্যোগে অবৈধ পাথর উত্তোলন এখন অনেকটাই কমেছে।
আপনার মন্তব্য