০৫ আগস্ট, ২০২৫ ০০:০৯
ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ওইদিনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণঅভ্যূত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ।
এই একবছরে সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরভাবে ঢালাওভাবে মামলা হয়। তবে এসব মামলার বেশিরভাগ আসামিই থেকে গেছেন অধরা। আসামিদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
গত একবছরে সিলেট জেলা ও মহনগরীর বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হয় প্রায় দেড় শ' মামলা। এসব মামলার আসামি ২৫ হাজারের বেশি থাকলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৩১৪ জন। প্রায় ২৫ হাজার আসামিই ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু আসামিই নয়, আন্দোলন দমাতে রাজপথে প্রদর্শিত অবৈধ আগ্নেয়ান্ত্রও উদ্ধার হয়নি।
যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, আসামিদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। আসামিদের বেশিরভাগই আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে পুলিশের এ বয়ানে অসন্তোষ্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেকেই। তাদের দাবি, আসামিদের অধিকাংশই দেশে অবস্থান করছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরব রয়েছেন। কেউ কেউ নিয়মিত কর্মস্থলে যাচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না, বা ধরার চেষ্ঠা করছে না।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেট। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মারমুখী অবস্থানে ছিলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা। এতে ১৮ জন শহীদ হন। আহত হন হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা।
এসব ঘটনায় ১৯ আগস্ট প্রথম মামলা হয়। এর পর থেকে জেলা পুলিশে ৩৯ টি ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) ১০৩টি মামলা করে। এসব মামলার আসামি করা হয় ২৫ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে। যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিও। তবে মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৩১৪ জন। এদের অনেকেই জামিনও পেয়েছেন।
পুলিশ ও আদালতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৯টি হত্যা মামলা হয়েছে সিলেট-৬ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিরুদ্ধে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলামের নামে সর্বাধিক ৪৩টি বিস্ফোরক ও তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজের বিরুদ্ধে আটটি হত্যাসহ ৪৪ মামলা হয়েছে।বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লবের নামে সাতটি হত্যা, সিলেট সিটি করপোরেশনের বহিষ্কৃত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ রয়েছে ৪৩ মামলা।
এছাড়া সিলেট-৩ আসনের সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবের নামে ২৩, মৌলভীবাজার-২ আসনের সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের বিরুদ্ধে ২০, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর নামে ১৩, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ছয়, সাবেক কাউন্সিলর রুহেল আহমদের নামে দুটি হত্যাসহ ২৮, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি কিশওয়ার জাহান সৌরভের বিরুদ্ধে ১৩, সম্পাদক নাঈম আহমদের নামে হত্যাসহ ২০ ও মহানগর যুবলীগের সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদারের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামিদের মধ্যে সাবেক সাংসদসহ সিলেট জেলা ও মহানগর এবং বিভিন্ন উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ সারির নেতাদের অধিকাংশ গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ সংখ্যা ৫'শয়ের বেশি হবে না।
এর মধ্যে শতাধিক আসামি এখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে দেশটিতে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ের’ (অ্যাসাইলাম) আবেদন করেছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থান নেয়া আসামিদের মধ্যে শফিকুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, হাবিবুর রহমান হাবিব, রণজিৎ সরকার, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহ আহমদ সেলিম, জেলা তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোবাশ্বির আলী, আওয়ামী লীগ নেতা আফছর আহমদ, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহিদ সারোয়ার সবুজ, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ হান্নান, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপু, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু জাহিদ, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার বহিষ্কৃত মেয়র আমিনুল ইসলাম রাবেল, মহানগর যুবলীগ নেতা আজাদুর রহমান চঞ্চল, এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব প্রমুখ রয়েছেন।
ভারতে অবস্থানকারী আসামিদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান, সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মো. আফসার আজিজ, মহানগর সভাপতি আলম খান মুক্তি, জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গির আলম, সিলেট জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি পিযুষ কান্তি দে প্রমুখ। কানাডায় অবস্থান নিয়েছেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদসহ আরও কয়েকজন আসামি।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আসামি ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশি অভিযানে অনেক আসামি ধরা পড়েছেন। কিন্ত আসামিদের বেশিরভাগই আত্মগোপনে রয়েছে, দেশের বাইরেও চলে গেছে অনেকে। এ কারণে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, যারা দেশে আছেন তাদের অবস্থান শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
অপরদিকে আসামি গ্রেফতারে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ও একটি বিস্ফোরণ মামলার বাদি বিলাল আহমদ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসামিদের অধকাংশই বাসা-বাড়িতে থাকছেন। কেউ কেউ অফিস করছেন, শহরে ঘুরছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সরব রয়েছেন অনেকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা ধরা পড়ছে না।
আপনার মন্তব্য