নূরুল মোহাইমীন মিল্টন

০৩ মার্চ, ২০১৫ ১৯:০৩

চা শিল্পে নারী শ্রমিকদের কষ্টের জীবন

‘বাবু আমরা লম্বরেও ভিজি, ঘরেও ভিজি। বউ, বাচ্চা, গরু-ছাগল নিয়া একঘরে থাকি। বহুত কষ্টে চলতে আছি।’ কথাগুলো চা শিল্পে কর্মরত ৭৭ বছর বয়সী নারী শ্রমিক বালিয়া রবিদাসের। বালিয়া রবিদাস মৌলভীবাজারের ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগর চা বাগানের। চা বাগানে কর্মরত নারী শ্রমিকরা কিভাবে আছেন। তাদের দুঃখ, দুর্দশার অন্তহীন চিত্র শ্রমিক কলোনী ও শ্রমিকদের বাহ্যিক চাকচিক্য থেকেই ফুটে ওঠে। সহজ, সরল ও সাবলিল ভাষায় ওই মহিলা শ্রমিকের উক্তিটি অনুধাবন করলেই তাদের দু:খ-কষ্ট বুঝতে কারো অসুবিধে নেই।
    ব্রিটিশ আমল থেকেই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ চা শিল্প শ্রমিকরা। ওই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে হাজার হাজার নারী শ্রমিকরা। একাধারে ঘরে বাইরে চলছে তাদের কাজ। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারায় হাড্ডিসার দশা। চা বাগানের এই নারী শ্রমিকরা জীবিকার তাগিতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠিন কাজ করে চলেছেন। দু’টি হাত সারাক্ষণ পাতি উত্তোলনে থাকে ব্যস্ত। রোদ, বৃষ্টিতে ভিজেই চলে তাদের কাজ। এরপর মজুরি! সেটিও নামে মাত্র।
    অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সংকট প্রবল। অজ¯্র সমস্যায় জর্জরিত চা শ্রমিকরা এক ঘরে গাদাগাদি করে দুঃখ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছেন। নারী শ্রমিকরা সকালে এক কাপ লাল চায়ের সাথে দুইটি রুটি গিলে কাজে বের হন। সাথে করে নিয়ে যান দু’টি রুটি। দুপুরে কাজের ফাঁকে গাছের ছায়ায় বসেই একটু বিশ্রাম নেন। সে সময়ে চা পাতা, আলু, শুটকি, মরিচ দিয়ে চাটনী তৈরি করে দু’টি রুটি দিয়েই গিলে নেন। রাতে জুটে একমুঠো ভাত। তাতেও সপ্তাহে একদিন মাছের দেখা পাওয়া দুরহ্ বলে জানান চা শ্রমিক মহিলারা।
    চা বাগানে পাতি উত্তোলনকারী নারী শ্রমিকরা এভাবেই তাদের দু:খ কষ্টের চিত্র তুলে ধরেন। বাছিয়া রবিদাস বললেন, ‘ঘরের উপরে পানি পড়ে। এই রুজি দিয়ে খাওয়ার তো হয় না। ঘর বানামু কিভাবে।’ ওই বাগানের ফুলমতি রবিদাস বলেন, ‘ঘরে স্বামী ছেলে মেয়ে নিয়ে ৭ জনের বসবাস। বাগানে একটা নামে কাজ করে দৈনিক পাওয়া যায় ৬৯ টাকা। তাই বস্তি গ্রামে কাজ করে বহুত কষ্টে চলতে হয়।’ প্রসাদ রবিদাস বলেন, ‘পরিবারে ৫ জন সদস্য। ছেলের বউর নামে কাজ করে, বাকি সবাই বেকার।’ এভাবে পরিবারের একজনের নাম থাকলেও অন্যরা থাকে বেকার।
    শমশেরনগর চা বাগানের ৭১ বছর বয়সী নারী চা শ্রমিক বাছিয়া রবিদাস বললেন, ‘বিরটিশ (ব্রিটিশ) আমলে দুধ খাইয়া পেট ভরি গেছে। এখন খাইবার পাই না। এখনের খানি লবন, আটার রুটি আর লাল চা। বিরটিশ আমলে সমান রেশন ও তলব দিয়া গেছে মালিক। আর এখন জমিনেরও খাজনা কাটিয়া রাখে। বহুত দু:খে আছি আমরা বাগানি মানুষ।’ একজন নারী শ্রমিক দৈনিক সর্ব্বোচ্ছ ২৫ থেকে ৩০ কেজি পাতি উত্তোলন করে মজুরি হিসাবে সপ্তাহে যেটুকু পান সেটি বাস্তবিকই অমানবিক পর্যায়ের চিত্র। এই পরিমাণ কাঁচা চা পাতি দিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কেজি চা উৎপাদন হয়। আর উৎপাদিত ওই চায়ের নিলম মূল্যও যদি দুইশ টাকা কেজি ধরা হয় তাহলে একজন নারী শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় এক হাজার টাকার আয় তোলে দিচ্ছেন কোম্পানীকে। বিনিময়ে ৬৯ টাকা থেকে অতিরিক্ত ও রেশনিং মিলিয়ে ৯০ টাকার মতোই পাচ্ছেন শ্রমিক। তা থেকেও মাসে ইউনিয়ন চাঁদা, পুজা ও অন্যান্য খাতের টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে।


    চা বাগানের ওই নারী শ্রমিকদের বাচ্ছারা কিভাবে খায়, কিভাবে চলে এই চিন্তায় তাদের দিন অতিবাহিত হয়। তাদের কাপড়ের দু:খ, খাওয়ার দু:খ, লেখাপড়ার দু:খ, চিকিৎসার দু:খ। দু:খে দু:খেই চলছে তাদের জীবন। চা শিল্পে নিয়োজিত এই শ্রমিকরা দৈনিক সর্ব্বোচ্ছ মজুরি ৬৯ টাকা দিয়েই ৮ থেকে ১০ জনের সংসারও চালান। পাতি উত্তোলন করতে গেলে বিছা, সাপ, জোঁকের আক্রমন ছাড়াও রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হয়। চা গাছের পানিতে সারা শরীর ভিজে আবার রোদে শুকায়। হাতের আঙ্গুলে ব্যাথা হয়। তা নিয়েই কাজ চালাতে হয় তাদের। কিন্তু চায়ের দাম, জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বাড়েনি তাদের মজুরি। বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের মজুরি দেয়া হলে সংসারে কিছুটাও লাঘব হতো। চা শ্রমিকদের যে দাবি দৈনিক তিনশ’ টাকা মজুরি তা নিতান্তই অমুলক বলা যাবে না। শিল্পের পরিশ্রমী নারীদের বাঁচিয়ে রাখতে তাদের কষ্টের লাঘব করার বিকল্প নেই।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত