নিজস্ব প্রতিবেদক, কমলগঞ্জ

১৩ জুন, ২০১৫ ২২:২৩

মাগুরছড়া ট্র্যাজেডি : ১৮ বছরেও ফিরেনি বনের স্বাভাবিক পরিবেশ

মাগুরছড়া গ্যাস কূপ ট্র্যাজেডির ১৮ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৯৭ সনের ১৪ জুন কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাস কূপে অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর ড্রিলিং চলাকালে ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি। ফিরে আসেনি এখনো প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।

২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টালের গ্যাস কূপ খননের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেনি। ২০০৮ সালে মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ায় শেভরন ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্নকালে বিভিন্ন এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়।

লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালের দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল গ্যাস উত্তোলনকারী অক্সিডেন্টাল কোম্পানী। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করে ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ১৪ জুন মধ্য রাত ১টায় ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের পরিবেশের জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর ও পান জুম, পিডিবির ৩৩ হাজার বিদ্যূৎ লাইনের।

পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগান সহ ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া ২শ’ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। দূর্ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ফুলবাড়ি চা বাগানের ক্ষতিগ্রস্ত টি প্ল্যান্টেশন এলাকার ক্ষতিপূরণ, খাসিয়া পুঞ্জির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা দাবীর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ও বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়।

দূর্ঘটনার ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ পায়নি রেল সেকশন, ক্ষতিগ্রস্ত বন, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের। বন বিভাগের হিসাবমতে প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ দশমিক ৫৩ কোটি এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপন করে অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়। দুর্ঘটনার সময়ে তৎকালীন অওয়ামীলীগ সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করেছিল। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।

মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান বলেন, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তা বুঝতে পারছি।

সিলেট বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) মাহবুবুর রহমান বলেন, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয়।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাগুরছড়া দুর্ঘটনায় শুধু পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ৬শ’ কোটি টাকা। ১৯৯৯ সালের আগষ্ট মাসে অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসকূপসহ তাদের ব্যবসা মার্কিনের অন্য কোম্পানী ইউনিকলের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনিকল দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষতিপূরন বিষয়ে টালবাহানা শুরু করে।

শেভরন সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সনের ত্রি-মাত্রিক ভূ-ত্বাত্তিক জরিপ অনুয়ায়ী কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগান থেকে দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকা পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় ৫ শতাংশ এলাকায় গ্যাস রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দেয়া এক রিপোর্টে জানা যায়, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ২০ একরে ৪.৭৫ ঘনফুট গাছ-গাছালির, ৫৫ হাজার ২’শ টি পূর্ণ বয়স্ক বাঁশ এবং ১ লাখ ১৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমান ৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২৬ একরের বড় আকৃতির বহু সংখ্যক দামী বৃক্ষ সম্পূর্ণ ও আংশিক পুড়ে যায়। একইভাবে ৪১.৫০ একরের ২২.৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি ধরা হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্থ বন ও পরিবেশের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানী সমূহের টাল বাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনের ১৮ বছরে ৩ টি কোম্পানীর হাত বদল হয়েছে। কিন্তু পুুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত