নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ মার্চ, ২০১৯ ১৪:৩৬

সেই ঐতিহাসিক ভবন রক্ষার দাবিতে সিলেটে মানববন্ধন

ঐতিহ্যবাহী ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ সুরক্ষার দাবি

সিলেটের ঐতিহাসিক 'আবু সিনা ছাত্রাবাস' ভেঙে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে হেরিটেজ ও পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো দুই দিনের কর্মসূচি পালন করছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ (মঙ্গলবার) মানববন্ধন ও আবু সিনা ছাত্রাবাস পরিদর্শন করা হয়। মানববন্ধনে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাকে সংরক্ষণ ও বিভাগীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুর সাড়ে ১২টায় কর্মসূচির প্রথম দিন সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এ মানববন্ধন করা হয়েছে।

বুধবার (১৩ মার্চ) হেরিটেজ নিয়ে কর্মরত সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর উদ্যোগে বিকাল ৪টায় আবু সিনা ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ‘প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি’ অনুষ্ঠিত হবে।

সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেটর উদ্যোগে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে নগরের বিভিন্ন শ্রেনীপেশার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে ভবনটি সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবী জানান ।

শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই ভবনের স্থাপত্য মূল্য ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে লিফলেট বিতরণ করে । প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী সমাবেশ শেষে একটি র‍্যালী 'আবু সিনা ছাত্রাবাস' পরিদর্শন করে এবং কাজ বন্ধের দাবীতে ব্যানার টানানো হয় । 

মানববন্ধন চলাকালে বক্তারা বলেন, 'কালের সাক্ষী ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ ঐতিহাসিক ভবনটিকে সংস্কার করে সুরক্ষা করতে হবে। অনুপম স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহাসিক সে ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার আয়োজন চূড়ান্ত। বাংলাদেশ পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ অনুযায়ী এটি ভাঙ্গা সম্পূর্ণ বেআইনি।'

বক্তারা বলেন, সিলেট নগরের হাজার বছর প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । বিভিন্ন শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে সুদৃশ্য স্থাপনা । কিন্তু ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হওয়ায় সিলেটে স্থাপত্য ঐতিহ্যের নিদর্শন বিভিন্ন সময়ে ধ্বংস হয়েছে । এ অবস্থায় নগরীর কেন্দ্র স্থলে ইংরেজী '0' অদ্যক্ষারের আদলে নির্মিত দেড়শ বছর প্রাচীন বৃটিশ কলোনিয়াল স্থাপত্য রীতির এই ভবন ভেঙ্গে ফেলা্র পরিকল্পনা অবিবেচনা প্রসূত হবে । অবিলম্বে এই পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে । এই স্থাপনা সংরক্ষণ করে সিলেট বিভাগীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রস্তাবিত ২৫০ শয্যার হাসপাতাল শহরতলীর টুকেরবাজার, বাদাঘাট বা অন্য কোথায় করার পরামর্শ দেয়া হয়। 

সিলেট নগরীর চৌহাট্টা এলাকার ঐতিহাসিক এই স্থাপনা ভেঙ্গে হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গত ১০ মার্চ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ 'সিলেটে হাসপাতাল নির্মাণে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়।

শতবর্ষী এই ভবনটি ভাঙ্গার খবরে ক্ষোভ প্রকা্শ করেন সিলেটের সচেতন নাগরিকরা। এটি সুরক্ষারও দাবি জানান তারা। এবার এই দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ অনুযায়ী এটি ভাঙ্গা সম্পূর্ণ বেআইনী। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব আইনে বলা আছে, কোনো ভবন বা স্থাপনা মূলত সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় সংরক্ষণ করা বা ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়। এই ভবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ও ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে । 

সমাবেশ থেকে বলা হয়, সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিলো এই ভবনে। 'শ্রীহট্ট প্রকাশ' প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে । ১৯৩৬ সালে এখানেই ছোট পরিসরে হাসপাতাল চালু করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ হাসপাতালের বর্ধিতাংশে বার্মা-ইংরেজ সৈনিকদের চিকিৎসা দানের লক্ষ্যে মিলিটারী হাসপাতাল চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এ ভবনে মেডিকেল শিক্ষাদানের জন্য নির্মাণ করা হয় ‘লাইসেন্সড মেডিকেল ফেকাল্টি’ (এলএমএফ)। ১৯৬২ সালে এটিকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করা হয় । ১৯৫৫ সালে এই ভবনের সম্মেলন কক্ষে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীত পরিবেশন করেন । এই ভবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িত । মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রফেসর ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শল্য বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (১৯৬৯-১৯৭১) হিসাবে দায়িত্বপালন কালেই পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন ।


সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট-এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী-এর সভাপতিত্বে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম "আবু সিনা ছাত্রাবাস সংরক্ষণ ও বিভাগীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠার আন্দোলন"-এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সুচনা বক্তব্য রাখেন ।  'আবু সিনা ছাত্রাবাস' নামের ভবনটির স্থাপত্য মূল্য ও ভবনটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত ব্যাক্ত করে বক্তব্য রাখেন লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট এর স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক স্থপতি রাজন দাশ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতি শুভজিৎ চৌধুরী । সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী-এর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না, সাম্যবাদী দল-এর কেন্দ্রীয় পলিটব্যূরো সদস্য কমরেড ধীরেন সিংহ, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেট-এর সভাপতি ও সাংবাদিক আজিজ আহমদ সেলিম, জাসদ (আম্বিয়া) সিলেট মহানগরী শাখার সাধারণ সম্পাদক জাকির আহমদ, মহানগর আওয়ামীলিগ-এর তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তপন মিত্র, প্রবাসী সমাজকর্মী আলমগীর কুমকুম, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সহ-সভাপতি ডঃ নাজিয়া চৌধুরী ও যুগ্ম সম্পাদক ছামির মাহমুদ, তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে যাদু, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুল বাসিত শেরো ও সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক স্থপতি কৌশিক সাহা ও সুব্রত দাস এবং নৃতত্ব বিভাগের শিক্ষক আফম জাকারিয়া, কিডনি ফাউন্ডেশনে কো-অর্ডিনেটর নারী নেত্রী ফরিদা নাসরিন, টিআইবি সিলেট-এর সহকারী ব্যাবস্থাপক আশফাকুন নুর, আবু সিনা ছাত্রাবাসের প্রাক্তন আবাসিক ছাত্র ডাঃ জালাল আহমদ চৌধুরী, বাসদ (মার্কসবাদী) ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট এর সংগঠক রুবাইয়াৎ আহমেদ, স্থাপত্য সংঘ শাবিপ্রবি-এর সহ সভাপতি সুমন পাল প্রমুখ । 


প্রসঙ্গত, সিলেট নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় আসাম প্যাটার্নের ‘ইউ’ আকৃতির একটি একতলা বিশাল ভবন। দেখলেই মনে হয় পুরনো জমিদার বাড়ি। প্রাচীন এই ভবনটি এই প্রজন্মের নগরবাসীর কাছে ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধসহ আর বহু ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো এই ভবনটি সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ভবন ভেঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল। ইতিমধ্যে ভবনের একাংশ ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এ নিয়ে সিলেটের সচেতন মানুষদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দাবি উঠেছে ভবনটি না ভেঙ্গে সেখানে মিউজিয়াম তৈরি করার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত