হৃদয় দাশ শুভ, শ্রীমঙ্গল

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ১৯:১৫

বাইক্কা বিলে কমেছে পাখির সংখ্যা, বেড়েছে প্রজাতি

ছবি: মো. সামিয়াত জামান খান জিকো

দেশের অন্যতম অতিথি পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কা বিল। শীতে এ হাওরে সাইবেরিয়া, চীন, হিমালয়, ভারত, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জড়ো হয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার এ বিলে। এ জন্য ২০০৩ সালে উপজেলার হাইল হাওরের প্রায় ১২০ একরের বাইক্কা বিলকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সরকার।

বিশ্বের শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীত যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন এ দেশের আতিথ্য নিতে ছুটে আসে পরিযায়ী পাখিরা। প্রতিবারের মতো এবারও পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসলেও এবারে পাখির সংখ্যা কম। তবে পাখির সংখ্যা কমলেও বেড়েছে পাখির প্রজাতি।

বাইক্কা বিলকে অভয়াশ্রম ঘোষণার শুরু থেকেই বাইক্কা বিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করে আসছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বড় গাঙ্গিনী সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর পাখির সংখ্যা কমে এসেছে মারাত্মকভাবে। যার জন্য প্রধানত দুটি কারণকে দায়ী করছে সংগঠনটি। জলজ বন কমে যাওয়া এবং শীত কম থাকা।

এদিকে বাইক্কা বিলের ভেতরে পাখি শিকার বন্ধ থাকলেও হাইল হাওরের বিশাল এলাকায় জনবল সংকটের কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না পাখি শিকার। প্রতি রাতেই বিষটোপ এবং বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে নতুন নতুন পদ্ধতিতে পাখি শিখার করছে পাখি শিকারিরা।

সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সোবান চৌধুরী বলেন, ‘এ বছর শীত বেশি পড়েনি তার ওপর প্রাকৃতিক কারণে কমে গেছে জলজ বন। পরিযায়ী পাখীদের বড় একটি অংশ পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদিসহ পদ্মপাতাকে ঘিরে বসবাস করে। এসব জলজ বন থেকে নানা ধরনের উদ্ভিদ এবং পোকা খেতে পছন্দ করে। কিন্তু গত বর্ষায় প্রচুর কচুরিপানা থাকায় পানির নিচে থাকা জলজ বন কচুরিপানার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে জলচর পাখিদের সংখ্যা কমে এসেছে। ১২০ হেক্টরের বাইক্কা বিলের আয়তন বেড়েছে আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে। বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ৩০০ হেক্টর। আমাদের ৬ জন প্রহরী বাইক্কা বিলকে চোরা শিকার থেকে মুক্ত রাখতে পারলেও হাইল হাওরের মতো বিশাল এলাকা সামলাতে প্রচুর জনবল প্রয়োজন।

বাইক্কা বিল ঘুরে দেখা যায়, পাখির আগমন ঘটলেও তা খুবই কম। বাইক্কা বিলের ওয়াচ টাওয়ারের সামনের অংশে অন্যান্য বছর জলজ বনে যেভাবে পাখির উপস্থিতি দেখা মিলত, এ বছর তা নেই। ওয়াচ টাওয়ারের বামপাশের কিছু অংশ ছাড়া বিশাল অংশ জলজ বন শূন্য। জলজ বন কমে গেছে অন্তত ৫০ শতাংশ। অন্যান্য বছর থেকে পাখির সংখ্যা এ বছর কম হলেও এ বছর বেড়েছে পাখির প্রজাতি। গত বছর বাইক্কা বিলে ৩৯ প্রজাতির পাখির দেখা মিললেও এ বছর এখন পর্যন্ত (৫ জানুয়ারি) ৭০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। যা নানা প্রজাতির পাখির জন্য বাইক্কা বিল আদর্শ জায়গা হিসেবে প্রমাণ করে।

বাইক্কা বিলে পাখির ছবি তুলতে এসেছেন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার মো. সামিয়াত জামান খান জিকো। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর এ মৌসুমে পাখির ছবি তুলতে আমি বাইক্কা বিল আসি। এ বছর পাখির উপস্থিতি অন্যান্য বছর থেকে কম। তবে আমি ৭০ প্রজাতির পাখির দেখা পেয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজ সরালি, সরালি, বালিহাঁস, পাতি তিলি হাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, গয়ার বা সাপপাখি, পাতি কূট, পাতি পানমুরগি, বেগুনি-কালেম, পানকৌড়ি, কানিবক, ডাহুক, জলময়ূর, ছোট ডুবুরি, ধলাবক, বেগুনি বক, ধূপনি বক, মাছরাঙা, গোবক, লাল ফিদ্দা, বড়গুটি ঈগল, পুবের পানকাপাসি, পালাসি কুরাঈগল, শঙ্খচিল, প্রায় ৫-৭ প্রজাতির ফুটকি, কালা লেজ জৌরালি, তিলা লালপা, বিল বাটান, গেওয়ালা বাটান, কালাপাখ ঠেঙি, লাল লতিকা টিটি, মেটেমাথা-টিটি, রাঙাচ্যাগা ইত্যাদি।

অভিযোগ রয়েছে, বাইক্কা বিল এবং হাইল হাওর থেকে রাতের আঁধারে প্রতিদিন পাখি শিকার করছে চোরা শিকারিরা। যা ভোরের আলো ফোটার আগেই মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট হাতে এবং স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যার প্রমাণও মিলেছে ছবিতে। পাখিপ্রেমী খোকন সিংহ জানান, তিনি প্রতি সপ্তাহে বাইক্কা বিল আসেন। বাইক্কা বিলে অনেক সময় বিষটোপ দিয়ে হত্যা করা পাখির মৃতদেহ দেখেছেন এবং সম্প্রতি এমন একটি পাখির ছবি ধারণ করেছেন।

পাখি শিকারের বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগ) আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘পাখিদের কেউ যেন শিকার করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা অতিরিক্ত সতর্ক আছি। তবে আমাদের জনবল দিয়ে বিশাল এলাকা পাহারা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ জনগণ সচেতন হলে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাইক্কা বিলে অতিথি পাখি আসে। গত বছর এর আগের ১০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ পাখি আসে বাইক্কা বিলে। ২০১৯ সালের পাখি শুমারিতে ৩৯ প্রজাতির ১১ হাজার ৬১৫টি পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়ে বিপন্ন ৫ প্রজাতি বড়গুটি ঈগল, পালসি কুড়া ঈগল, উদয়ী গয়ার, কালা মাথা কাস্তেচরা ও মরচেং ভূতিহাঁস পাখি ছিল উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক বলেন, ‘এ বছর যেহেতু এখনো পাখি শুমারি হয়নি, তাই বলা যাবে না পাখি কম এসেছে নাকি বেশি এসেছে।’ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি বাইক্কা বিলে ঘুরে গেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমার চোখে অনেক প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। তবে পাখি যদি কম এসে থাকে সেটা হবে দুঃখজনক। এ মাসের শেষেই আমরা পাখি শুমারি করব। তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে পাখি কম নাকি বেশি এসেছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহ্বায়ক আ স ম সালেহ সুয়েল বলেন, ‘পাখি শিকারিরা বিভিন্ন কায়দায় পাখি ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। তাই এসব অতিথি পাখি আর বাইক্কা বিলকে নিরাপদ ভাবছে না। ফলে কমছে অতিথি পাখির সংখ্যা। সেই সাথে নিয়ম না মেনে বাইক্কা বিলের আশেপাশে তৈরি করা হচ্ছে ফিশারি। যার কারণে উদ্ভিদ ও জলজ বৈচিত্র্য নেই। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে পারলে সারা বছর এখানে পাখি থাকবে। জলজ উদ্ভিদের ভেতর লুকিয়ে থেকে পরিযায়ী পাখিরা নিজেকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে এবং খাবার সংগ্রহ করে। জলজ বনে জলময়ূরসহ অনেক প্রজাতির পাখি ডিম পাড়ে। তাই জলজ বন না থাকলে পাখি আসবে না। এগুলোর দিকে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত