মোসাইদ রাহাত, সুনামগঞ্জ

০৮ মার্চ, ২০২০ ১৫:০৭

সুনামগঞ্জে পল্লীফোনের প্রথম নারী ব্যবসায়ী করিমুন

সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় একজন মানুষ করিমুন নেছা। নারী কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা হওয়ার মধ্যে তিনিই ছিলেন সুনামগঞ্জের প্রথম মহিলা। ২০০৩ সাল থেকে পল্লী ফোনের ব্যবসা করে আজ তিনি একজন সফল নারী। বাবা-মা বিরুদ্ধে গিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই নিজের ভাগ্য লিখেছেন তিনি। ১৭ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা।

সুনামগঞ্জের মানুষের যখন ফোনে কথা বলার সুযোগ ছিলো না তখন তিনি তার জমানো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন পল্লী ফোন ব্যবসা। সুনামগঞ্জের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম কোনও ব্যক্তি যিনি পল্লী ফোনের ব্যবসা শুরু করেন।

সরেজমিনে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ঘোলঘর এলাকায় গিয়ে দেখাযায় করিমুন পল্লী ফোন সেন্টার নামে একটি দোকান রয়েছে। একসময় ১০ টাকা মিনিটের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা করে দেওয়া করিমুন নেছা বর্তমানে একজন সংরক্ষিত ওয়ার্ড মেম্বারও। মেম্বার হয়েও ছাড়েননি নিজের প্রথম ব্যবসা। এখন আর স্বামীর সাথে নেই তার যোগাযোগ। দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে স্বামী সুখে থাকায় এবং মাঝে মধ্যে তার খোঁজখবর নেওয়া হলেও ঘরে নেই কোনও সন্তান। সেই সন্তান না হওয়ার আক্ষেপও নেই করিমুন নেছার। জীবনের শুরুটা যেখানে মানুষের জন্য করেছেন শেষটাও ঠিক সেইভাবেই করতে চান তিনি।

করিমুন নেছার সাথে কথা হলে তিনি জানান, ১৯৮৯ সালে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু দিন সেলাই কাজ করেন তিনি। পরবর্তী ১৯৯১ সালে গণশিক্ষার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজও করেন তিনি। সেই সময়ের ২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে নিজের ব্যক্তিগত খরচ শেষে যা অবশিষ্ট থাকতো তা তিনি জমিয়ে ২০০৩ সালে শুরু করেন পল্লী ফোনের ব্যবসা। তখনকার সময়ে মানুষ লাইন ধরে তার গ্রামীণফোন থেকে পাওয়া পল্লী ফোনের কথা বলতো ৮-১০ টাকা মিনিটে। যুগের পরিবর্তনে মানুষের হাতের নাগালে মোবাইল ফোন চলে আসায় ব্যবসায় ক্ষতি হতে থাকে তার। পরবর্তীতে মোবাইলে কার্ডের রিচার্জ এবং বর্তমানে ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশ এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

বাবা-মা কোনও সময় ছিলেন না তার পক্ষে, বাইরের লোক কি বলবে সেই কারণে মেয়েকে ব্যবসায় করার অনুমতি দেননি তারা। যার কারণে চাচাতো ভাই-বোনেরা তার সাথে কথা বলেননি ২-৩ বছর। পরবর্তীতে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে করিমুন নেছাকে সাহস যুগিয়েছেন অনেক।

পরবর্তীতে নিজের ইউনিয়ন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবান নগর ইউনিয়নে মহিলা সংরক্ষিত ওয়ার্ড মেম্বার হয়ে ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি হয়ে কাজ করছেন সুনামের সাথে। সৎ পথে থাকার একটি শপথ নিয়ে শুরু করা করিমুন নেছার বর্তমানে অভাব অনটন নেই বললেই চলে।

করিমুন নেছা বলেন, আমার স্বপ্ন ছিলো সরকারি চাকুরীজীবী হওয়ার। অনেকবার অনেক সরকারি কার্যালয়ে ইন্টারভিউ দিলেও চাকুরী হয়নি। পরে আমি কাজ করেছি গণশিক্ষায় মাঠকর্মী হিসেবে। সেখান থেকে যে টাকাটা পেতাম সেটার কিছু অংশ জমিয়ে শুরু করি ২০০৩ সালে পল্লী ফোনের ব্যবসা। সুনামগঞ্জের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রথম সেই ব্যবসার মধ্যে। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসতো এবং আমার ফোন দিয়ে কথা বলতো।

তার এই পল্লী ফোনের ব্যবসায় আসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সেই সময় দেখতাম মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একটি সহজ ব্যবস্থা ছিলো না। তাদের সিলেট গিয়ে কথা বলতে হতো কারো সাথে কথা বলতে হলে। তাই আমি ভাবলাম যদি এই ব্যবসা শুরু করি তাহলে মানুষের উপকার হবে এবং আমিও কিছু টাকা আয় করে সংসার চালাতে পারবো। সেই থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়। এখনো আছি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ করিমুন পল্লী ফোন ব্যবসাটি থাকবে।

করিমুন নেছা ২০০৫ সালে আচার-আচরণ ও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে নিজের এবং কেন্দ্রের সামাজিক উন্নয়নের জন্য কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংক বোদওয়াঁ পুরস্কার। তাছাড়া বর্তমানে নারী উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন তিনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি এখনো মনে করেন সমাজের নারী-পুরুষ সমতা বজায় নেই। নারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

তিনি বলেন, আমার ব্যবসা শুরু পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান অনেক। কিন্তু পরিবার থেকে ছিলো কড়া নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আমি ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু আমার মতো বর্তমানে খুব কমই নারী আছেন যারা নিজের মনের কথা শুনেন। বিশেষ করে গ্রামের দিকের মহিলারা অবহেলিত।

তাদের উন্নয়নে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, এখনো গ্রামের মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। কোনও কাজ করতে গেলে পরিবারের বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া পুরুষ চায় না তার স্ত্রী বাইরে কাজ করুক। একজন নারী চাইলে ঘরেই বসেই বিভিন্ন হাতের কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে কিন্তু তাতেও অনেকের আপত্তি রয়েছে। সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

তিনি একজন সংরক্ষিত ইউনিয়ন মেম্বারের উদাহরণ টেনে নিয়ে এসে বলেন, একজন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের বেতন অনেক টাকা। কিন্তু আমরা সংরক্ষিত আসনের মেম্বাররাও তার থেকে অনেক কম পাই। কিন্তু আমাদের একসাথে ৩টি ওয়ার্ড দেখতে হয় আর পুরুষদের প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে। তাহলে সেখানে নারীদের কাজের চাপ বেশি দেওয়া হলেও সম্মানী কিন্তু দেওয়া হচ্ছে ওয়ার্ড মেম্বারদের থেকে কম। তাই সরকারের উচিত সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রদান করা।

ব্যবসায় ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সুনামগঞ্জের প্রথম ব্যক্তি ছিলাম পল্লী ফোনের। আমার দেখাদেখি অনেকে সেই ব্যবসা শুরু করেন কিন্তু তাদের ও আমার মধ্যে তফাৎ ছিলো আমি ন্যায্য দামটা রাখতাম আর অন্যরা একটু বাড়িয়ে রাখতো। যার কারণে অনেকবার আমার দোকান চুরি হয়েছে। তাছাড়া যখন বিকাশ আসলো তখনো আমি দেড় লক্ষ টাকা হারিয়েছি। যার কারণে আমাকে ঋণ করে দোকানটি পুনরায় দাঁড় করাতে হয়েছে।

বর্তমানে তার সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে করিমুন নেছা বলেন, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি। ব্যবসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে এক হয়ে কাজ করছি। আমার ইউনিয়নের মানুষের উন্নয়নে কাজ করছি, বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার বিষয়ে আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ছেলে-মেয়ে নেই তো কি হয়েছে, এই যে আমি যাদের নিয়ে কাজ করছি তারাও আমার ছেলে-মেয়ে।

বর্তমানে নারীদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমাদের বর্তমান নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে ভয় পেলে হবে না। কারণ বর্তমান সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে নারীর কর্মসংস্থানের জন্য। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। আমাকে দেখে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা হলেও কিন্তু তারা পরিবারের চাপে বেশিদূর আগাতে পারেননি। কিন্তু আমি চাইবো পরিবারকে বুঝিয়ে হলেও একজন নারী ঘরে না বসে থেকে কাজ করুক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত