ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন

০৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ১৮:৪৫

‘অস্থিরতার খেসারত দিয়েছেন সোয়েব ভাই’

দিনটা গুমোট। একেতো শীত কাল। তার উপর বৃষ্টির অনাসৃষ্টি। এমন দিনে সকাল গুমোট হয়। ঘরে বাইরে মলিন, বিরক্ত বদনের সমাহার। যেন, সব আঁধার নেমে এসেছে এ ধরায়।
এমন দিনে কেউ কারো খুঁজ করে কদাচিৎ, নেহায়েত কারনে এবং নির্ঘাত দুঃসংবাদ দেয়ার জন্য।

দেশ থেকে বার্তাটি আসে অগ্রজ লোকমান আহমদের কাছ থেকে। জানান, সোয়েব আহমেদ চৌধুরী আর নেই। কর্মদিনের গুমোট অবস্থা ঝাড়ি দিয়ে বাড়ি পাঠাই। ফোন করি লোকমান ভাইকে।

জানালেন, একদিন আগেও শহীদ মিনারে একসাথে ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে শেষ বিদায় জানাতে। আগাম কোন সংকেত ছাড়াই চলে গেছেন সোয়েব আহমেদ চৌধুরী।

সুদর্শন সোয়েব ভাই। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত টগবগে তরুণ। অভিজাত পরিবারের সন্তান। চেহারায় অভিজাত্য। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন মুক্তিযোদ্ধা সোয়েব চৌধুরী। গেছেন আখতার আহমদের কাছে বিদায় নিতে। অগ্রজ নেতা আখতার আহমেদ বারণ করলেন। বললেন শীঘ্রই দেশে নতুন জনযুদ্ধ শুরু হবে। এইসব ক্যপ্টেন মেজর হয়ে কি হবে?পুরো শ্রমিক শ্রেণীর রাজত্ব শাসন করতে হবে।

তখনকার নেতার প্রতি আনুগত্য থেকে শোয়েব ভাই আর সেনাবাহিনীতে গেলেন না। গল্পটি নিজেই শুনিয়েছেন আখতার ভাই জীবীত থাকতে।

অস্থির ছিলেন অথবা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন সোয়েব ভাই। রাজনীতি থেকে ব্যক্তি জীবনের নানা ঘটনায় আমরা অনেকেই জড়িয়ে গেছি। বিরক্ত হয়েছি, বিরক্ত করেছি। আবেগের উচ্ছ ধারার এ মানুষটি নিজেও ভোগেছেন অনেক।

অনক ঘটনা তাঁকে নিয়ে। দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নির্বাচনে প্রয়াত জননেতা আব্দুর রহিমের পালটা প্রার্থি করেছেন যুক্ত্রারাষ্ট্র প্রবাসী শেখ ওয়াহিদুর রহমানকে। নির্বাচনী প্রচারপত্র ছাপা হবে। সোয়েব ভাই লেখছেন, "তিনি বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্ছশিক্ষার্থে বিদেশ গমন করেন এবং দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার কাজে ঝাপিয়ে পড়েন।"

আমি বলি, ও সোয়েব ভাই-এর পর কি হলো?লোকটা কি বাল্যশিক্ষার পর আর কিছু করলেন? না বিদেশে গিয়ে কাজে লেগে গেলেন?

তোমাদের নিয়ে যতসব সমস্যা, বলেই প্রচারপত্র ছাপতে দিলেন।

সভা চলছে। বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দীর্ঘ বক্তৃতায় মগ্ন।সোয়েব ভাই পাশের আসন থেকে আমাকে উঠার নির্দেশ দিলেন । বললেন, এই লোকের বক্তৃতা শুনে লাভ নেই। চলো গিয়ে নিজেই একটা কলেজ চালু করি। আমি অধ্যক্ষ হবো, আর তুমি উপাধক্ষ্য হয়ে যাবে। তখন এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দেয়া যাবে। এই পদবীগুলো আমাদের দরকার এখন।

আমার পাবলিকা গাড়িতে উঠে বললেন, চলো জল্লার পারের দিকে যাই।
কেন?

ডা. হোসেন রাজার কাছ থেকে হেমিওপ্যাথি ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনা যায় কি না দেখি।

: কি করবেন ডাক্তারি সার্টিফিকেট দিয়ে।

: আরে নির্বোধ। ড. হলে আর কিছু লাগে না। সব যায়গায় বক্তব্য রাখার একটা পদবী হয়ে যায়।

ভালো মনের অসম সাহসী মানুষ ছিলেন সোয়েব ভাই।
তাঁর ছোট ভাই রেহান আমাদের বন্ধু ছিল।

দুর্ঘটনায় রায়হানের অপমৃত্যুর পর সোয়েব ভাইকে আর আগের মানুষ হিসেবে পাইনি।
রাজনৈতিক সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্কে গড়িয়েছিল। ক্ষ্যপাটে স্বভাবের বলেই হয়তো ভিন্নতা পেতাম। কাছে যেতাম সময় করে। অনেকটা বোহেমীয় স্বভাব ছিল। ক্ষোভ দ্রোহের মেজাজে আমাদের অভিন্নতা আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে তাঁর কাছাকাছি ভাবতাম। হয়তোবা আলাদা একটা সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল একারনেই।

আন্দোলন, সংগ্রামের বাইরে ব্যক্তিগত সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দুই দশকের টানা সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সোয়েব ভাই ছিলেন।

তাঁর অসম সাহসিক বহু কাহিনী সিলেটের রাজনৈতিক পরবারের জানা। অস্থিরতার খেসারত দিয়েছেন সোয়েব ভাই। তাঁর মেধা ও যোগ্যতাকে চাটুকারিতায় লাগাতে পারেননি। ফলে রাজনীতিতে প্রতারিত হয়েছেন বারবার।

নিজেকে নিঃশেষ করেছেন অবলীলায়।
তাঁর ব্যক্তি জীবনের শেষ দিকের খবর নেয়া হয়নি। দেশে গেলেও খোঁজ নেইনি, খোঁজ পাইনি।
হ্যাঁ, ব্যস্ততাই আমাদের অজুহাত।
সব ব্যস্ততার দ্রুতই অবসান হয়। প্রাণোচ্ছল মানুষগুলো দ্রুত চলে যায়।
অনেক না বলা কথা, না জানানো ব্যথা নিয়ে নিঃসঙ্গ যাত্রার অভিযাত্রী হয়েছেন সোয়েব চৌধুরী।

সেলাম। অন্তিম সেলাম।

ত্রিশ বছর আগে, কোন এক জোনাকি রাতে মুক্তিযোদ্ধের গল্প শুনিয়েছিলেন।
রাতের ট্রেন ঝিক ঝিক করে যাচ্ছিল। বলেছিলাম, এসব গল্প লিখে রাখতে হবে। তা আর হয়নি।

আজ আটলান্টিকের পারে খুব একা গাড়িতে বসে নিঝুম কিছু সময় কাটালাম।
ভালোবাসার অশ্রুতে আজ আর কারো যায় আসে না সোয়েব ভাই।
স্মৃতির প্রতি বুক ভরা শদ্ধা ভালোবাসা!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত