লিটন সি ভৌমিক

১৪ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ১৬:২৭

প্রেমকে কেন পুঁজিবাদী চক্রান্ত নামে ডাকতে হবে?

১. একই দিনে ভ্যালেন্টাইন আর স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। দুটি দিবসেরই সুন্দর দুটি অর্থ আছে: ভ্যালেন্টাইন ডে হলো, সুন্দর ভালোবাসা; আর স্বৈরাচার প্রতিরোধ হলো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। দুটি দিবসই দুপক্ষকে দেখলাম এক্সক্লুসিভ ঘরানার। এমন যে, একটি পালন-স্মরণ করলে আরেকটি করা যাবে না। 

যারা স্বৈরাচার দিবসের সাপোর্টার (খুব কম), এরা বলছে- ওসব বুর্জোয়া, পুঁজিবাদী এসব। যারা বিশাল ভ্যালেন্টাইনবাদী, তারা অনেকেই হয়তো জানেও না ওই দিনে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি বিশাল শিক্ষা আন্দোলন হয়েছিলো।

২. প্রেম করলে কেন সমাজের জন্য কন্ট্রিবিশন করা যাবে না? দুজন দুজনের হাত ধরলে কেন সময়ের প্রয়োজনে সে হাতে ব্যানার-মানববন্ধন করা যাবে না? যে কণ্ঠে প্রেমিককে গান শোনানো যায়; সেই কণ্ঠে কি প্রয়োজনে স্লোগান দেয়া যাবে না ?

আবার বিপ্লব-বিদ্রোহ করলে, কেন প্রেমকে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদী চক্রান্ত নামে ডাকতে হবে?

'এইসব আমাদের না' একথাটিও খুব সুন্দর শোনায় না। সংস্কৃতির রূপান্তর একটি সচল সমাজের অনিবার্য ধারাবাহিকতা। একটি মুক্ত, স্বাভাবিক আর সচল সমাজে তরুণরা নতুন কিছু করতে চেষ্টা করবেই। বাধা বা থামানো না তার এপ্রোচ নিয়ে কথা বলা যায়।

৩. ইউটিউবে দেখেছি; একটি ছেলে 'ইনস্পিরেশনাল ভিডিও সিরিজ' বের করলেন। এই কাজের ইন্সপিরেশন তার প্রেমিকা হতাশ বলে। ৫মিলিয়ন ভিউয়ার। আরেকটি ছেলে 'ঘুমানোর প্রয়োজনীয়তা' নিয়ে বিশাল বিশাল তথ্য উপাত্ত দিয়ে ভিডিও বের করলেন; তার প্রেমিকা 'ইনসমনিয়া'তে ভুগেন বলে। ৬ মিলিয়ন ভিউয়ার। অর্থনীতিতে পড়া পিএইচডি ছেলেটি তার প্রেমিকার জন্য ইউটিউবে বিশাল ইকোনমিক্সের ভান্ডার বানালেন, তার প্রেমিকা ইকোনোমিক্সে আন্ডারগ্রেডে।

উপরের তিনটি ছেলে চাইলে কেবল তার প্রেমিকার জন্য এসব মোবাইলে, স্কাইপে সারতে পারতেন। কিন্তু পুরো মানবজাতির জন্য উৎসর্গ করলেন।

৪. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দারুন সম্পর্কও দেখেছি। যেমন বর্ষার সাথে আরিফের। আরিফ ঝুপড়ীতে বসে বলেছিল- তুমি গান পার, আমি অভিনয় করতে পারি। চল দুজন মিলে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন খুলে ফেলি। চারুকলার দুটি ছেলেমেয়ে তাদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রতি শুক্রবারে চেরাগীতে প্রদর্শন করতো। কেউ দেখতে আসুক বা না আসুক তারা দুজন টাঙানো ছবির পাশে ভাস্কর্যের মত দাঁড়িয়ে থাকতো।

শীতে কয়েকটি জুটিকে দেখতাম ২ মাস ধরে শীতবস্ত্র সংগ্রহ-বিতরণ করেছে, চট্টগ্রাম মহানগরী দাপিয়ে। তারা পারস্পরিক উষ্ণতা নয়, গোটা শীতার্তদের উষ্ণতা নিয়ে ভেবেছিল। শাহবাগ-চেরাগীতে সুবিশাল মানববন্ধনে অজস্রজন হাতধরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি পরিচিত জুটিকেও দেখতাম। অজস্র হাত তাদের হাতের সাথে। তারাও পারতো ঘাপটি মেরে টিএসসিতে বসে থাকতে। কিন্তু অজস্র হাতদিয়ে তারা জন্ম দিয়েছিল সবচে সুন্দর দৃশ্যের। হুম প্রেম মানে, পরস্পর অন্তরঙ্গতার যেমন বিষয়; তেমনি প্রয়োজনে প্রসারিত হতে হবে।

৫. এবার আসি আমার প্রিয় কিছু পৃথিবী বিখ্যাত দম্পতির ভালোবাসার গল্পে।

পিয়েরি ক্যুরি আর মেরি ক্যুরি। প্যারিসের ল্যাবরেটরীতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মাটি কামড়ে থাকা দুজন বিজ্ঞানী। তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে ল্যাবে ডুবে থাকতেন; আর সাইকেল নিয়ে গোটা প্যারিসময় ঘুরতেন। তারা নোবেলও পেলেন, আবার দুটি নতুন মৌলেরও জন্ম দিলেন: রেডিয়াম, পোলেনিয়াম।

জ্যা পল সাত্রে আর সিমন দা বিভোয়া; তাদের বলা হয় 'Intellectual Powerhouse'. দু'জন রাতভর চিন্তা করতেন, লেখালেখি করতেন; দিনে প্যারিসের রেস্তোরাঁতে দুজন দুজনের কাজ চিন্তা শেয়ার করতেন। দুজন দুজনের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন; কড়া সমালোচনা করতেন; আবার তীব্র উৎসাহও দিতেন।

আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ছিল জন এডামস; তার প্রেমিকা ছিলেন এবিগেল এডামস। এই দুই রোমান্টিক জুটি দুজন দুজনকে ১২০০'র মতো চিঠি লিখেন। সব চিঠি উদ্ধার করে দেখা যায়: চিঠিগুলো মানবাধিকার, নারী অধিকার, ধর্ম, কর, বাজেট, অর্থনৈতিক সংস্কার এসব নিয়ে। দুজন দুজনকে পরামর্শ দিতেন।

আচ্ছা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব ধনী হাবীর স্ত্রীরা শপিংপ্রিয়, ব্যক্তিগত খরুচে হয়; তাই না ?
কিন্তু এই গ্রহের সবচে ধনী বিল গেটসের স্ত্রী মিলিন্ডা গেটস একটু ভিন্ন। বিল গেটস টাকা কামায়; আর মিলিন্ডা গেটস খরচ করে। সে তৃতীয় বিশ্বের জন্য এই ফান্ড বানায় ও ফান্ড বানায়। এমন কি মৃত্যুর পর মোট সম্পত্তির ৯৫ ভাগ দান করে দেওয়ারও ইচ্ছা রয়েছে এই দম্পতির। সব কোটিপতি দম্পতি যদি এভাবে দিয়ে মারা যেতো! (কোটিপতি শিল্পপতিদের আমার কেন জানি পছন্দ না; কিন্তু এই গেটস দম্পতিকে কিউট লাগে)

এই যে উপরের দম্পতিরা তারা যেমন দুজন দুজনকে ভালোবাসেন, তেমনি তাদের কাজ, দায়িত্বকেও ভালোবাসেন।

৬. সমস্যাটা ভালোবাসায় না, এ্প্রোচে। দুজন মাছি হয়ে পচা খাবারে খাবারে ঘুরবে, নাকি মৌমাছি হয়ে ফুলে ফুলে সৌন্দর্য্যে উড়বে। কাকের মতো ছোট্ট গন্ডিতে কাকা করবে, নাকি পরিযায়ী পাখির মতো বৃহৎ গন্ডিতে ঘুরবে। ব্যাঙের মতো বদ্ধ কুয়োতে থাকবে, নাকি মহাসাগরের সেইলফিশের মতো তীব্রগতিতে সাগর উপসাগর মহাসাগরে ছুটবে।

ভালোবাসতে চার হাত এক করতে হয়নারে বোকারা; দু'হাত দু'জনে রেখে বাকি দু'হাতে অনেক কিছু জয় করা যায়, অনেক কন্ট্রিবিউশন করা যায়।

 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত