নিজস্ব প্রতিবেদক

১৩ মে, ২০১৬ ১৮:০২

শিবির ছাত্রদল অছাত্র বিবাহিতদের নিয়ে শাবি ছাত্রলীগের কমিটি!

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ছাত্রদল ও শিবির নেতারাও ঠাঁই পেয়েছ বলে অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়াও বহিষ্কৃত, বিবাহিত ও অছাত্ররাও ওই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বলে ছাত্রলীগ নেতারা জানিয়েছেন।

দীর্ঘ ১৪ বছর পর গত মঙ্গলবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (শাবি) বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।

সূত্র মতে, ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা স্থান করে নিয়েছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, বিবাহিত ও অছাত্ররাও স্থান পেয়েছেন কমিটিতে।

ছাত্রদল-শিবির কর্মী :

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান। তিনি বর্তমান কমিটিতে পরিবেশ সম্পাদক পদ পেয়েছেন। তিনি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

বাংলা বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের লোকমান আহমেদ। তাকে আপ্যায়ন সম্পাদক করা হয়েছে। লোকমান ছাত্রদল ও শিবিরের বিভিন্ন মিছির-সমাবেশে অংশ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ।

একই অভিযোগ লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী মোবাশ্বির হোসাইন রাফি বিরুদ্ধেও। তিনি সহ-সম্পাদক (২৫তম) পদ পেয়েছেন।

কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন রাজুকে (কমিটিতে তার নাম মোশারফ হোসেন) সহ-সম্পাদক (১৩তম) এবং সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষের শামীম বিশ্বাসকে সদস্য (২৭তম) করা হয়েছে। তাদেরও ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং সরকার বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মীর সোহেল আহমেদ। তিনি ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি শাবি ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক এসএম জাহাঙ্গীরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ছাত্রদল থেকে এসে প্রথমে তিনি ছাত্রলীগের নছর গ্রুপ ও পরে ইমরান খানের সাথে যোগ দেন। তিনি কমিটিতে সহ-সম্পাদক পদ পেয়েছেন।

বহিষ্কৃত যারা :

গত বছরের ৩০ আগস্ট ভিসি বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের ওপর হামলা, অসৌজন্যমূলক আচরণে এবং চলতি বছর ২৮ জানুয়ারি বিকেলে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে র‌্যাগিং করার নিয়ে সংঘর্ষে জড়িত এমন ৯ জনকে শাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে।

তাদের মধ্যে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষকদের ওপর হামলা, অসৌজন্যমূলক আচরণে চার জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

বহিষ্কৃতরা হলেন- পরিসংখ্যান বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ধনী রাম রায়, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষা বর্ষের মো. আবদুল্লাহ আল মাসুম, বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষা বর্ষের আরিফুল ইসলাম এবং একই বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন নাঈম। ঘটনাটি এখনও তদন্তধীন।

এদের মধ্যে ধনী রাম রায়কে সহ-সভাপতি (৮ম), মাসুমকে সহ-সভাপতি (১৫তম), আরিফুল ইসলামকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (৬ষ্ঠ) এবং জাহিদ হোসেন নাঈমকে সাংগঠনিক সম্পাদক (৬ষ্ঠ) করা হয়েছে।

চলতি বছর ২৮ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ৩১ জানুয়ারি ৫ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

তারা হলেন- কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন রাজু, সমাজকর্ম বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষের অসীম বিশ্বাস, গণিত বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষের নজরুল ইসলাম রাকিব, একই বিভাগ ও একই সেমিস্টারের মোশারফ হোসেন (সবনীল) এবং একই সেমিস্টারের মাহমুদুল হাসান।

এদের মধ্যে মোশারফ হোসেন রাজুকে (কমিটিতে তার নাম মোশারফ হোসেন) সহ-সম্পাদক (১৩তম) পদ দেয়া হয়েছে। অসীম বিশ্বাসকে স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, নজরুল ইসলাম রাকিবকে সদস্য (২য়), মোশারফ হোসেন সবনীলকে সদস্য (৯ম), মাহমুদুল হাসানকে সদস্য (২০তম) করা হয়েছে।

বিবাহিত যারা :

শাবি ছাত্রলীগের কমিটিতে দুজন বিবাহিত স্থান পেয়েছে। তারা হলেন- লোক প্রশাসন বিভাগের ২০০৮-০৯ বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তাক আহমেদ মিয়াজী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষা বর্ষের তরিকুল ইসলাম এবং সমাজ কর্ম বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষা বর্ষের মো. মনিরুজ্জামান মনির।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মোস্তাক আহমেদ মিয়াজী ২০১১ সালের শেষের দিকে বিয়ে করেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায়। তার স্ত্রী নিগার সুলতানা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তাকে কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক (৩য়) করা হয়েছে।

মো. মনিরুজ্জামান মনির ২০১২ সালে সিলেটের জালালাবাদ থানার টুকের বাজার এলাকার মায়াকে বিয়ে করেন। পরে ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মায়াকে মনিরের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় নেয়া হয়। মায়া এখন মনিরের বাড়িতে অবস্থান করছেন। কমিটির সহ-সভাপতি (৯ম) পদে তার নাম রয়েছে।

অছাত্র যারা :

ছাত্রত্ব নেই এমন ১০ জন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন।

তারা হলেন- ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের মো. রুহুল আমিনকে সহ-সভাপতি (তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আছে), লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের কামরুল ইসলামকে সহ-সভাপতি (৫ম), একই শিক্ষাবর্ষের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুহিবুর ইসলাম মিছবাহকে সহ-সভাপতি (৬ষ্ঠ), লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল কাদির রেদোয়ানকে সহ-সভাপতি (১০ম), রাসয়ন বিভাগের ইয়াসিনুল হায়দার রুপককে সহ-সভাপতি (১১তম), রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের আলী আকবরকে সহ-সভাপতি (১৪তম), লোক প্রশাসন বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শরিফুল ইসলাম বুলবুলকে সহ-সভাপতি (১৬তম), লোক প্রশাসন বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তাক আহমেদ মিয়াজীকে (বিবাহিত) সাংগঠনিক সম্পাদক (৩য়), রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবীর হাসানকে ছাত্রবৃত্তি সম্পাদক, সমাজকর্ম বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী আব্দুস সালাম মঞ্জুকে সহ-সম্পাদক (৭ম) করা হয়েছে।

ঠাঁই পেয়েছেন অপরাধীরা :

শাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন অপরাধীরাও। ক্যাম্পাসের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত নজরুল ইসলাম পেয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক পদ। ২০১৪ সালে সহকারী প্রক্টর মিরাজুল ইসলামকে পেটানোর দায়ে তাকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে ফাও খাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি শাহপরাণ আবাসিক হলের বাছিত মিয়ার ক্যান্টিন, পরোটার দোকান এবং জসীম মিয়ার টং দোকানে ফাও খাবার খান।

কমিটিতে স্থান পেয়েছেন সাবেক ছাত্রদলকর্মী এবং নকলের দায়ে বহিষ্কৃত সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ২০১৫ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় নকলের দায়ে বহিষ্কৃত হন। পুরো ক্যাম্পাসে তিনি ফাওখেকো এবং ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে শাবি ছাত্রলীগ বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাস মিছিল করে

২০১৪ সালের ১৪ মে শাবি ছাত্রলীগের আসাদ গ্রুপের সঙ্গে উত্তম অঞ্জন অনুসারী সংঘর্ষের সময়  প্রায় ১০টি কক্ষ থেকে ল্যাপটপ মোবাইল চুরি এবং ১৯ মে পার্থ-ইমরান অনুসারী সঙ্গে উত্তম অঞ্জন অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় লুটপাট হয়। এসব ঘটনায় নজরুল ইসলাম এবং সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে প্রায় ১০টি ল্যাপটপ ও অনেকের মোবাইল চুরির অভিযোগ ওঠে। অনেক ছাত্রলীগকর্মী সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নজরুল ইসলাম বলেন, কমিটি হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চক্রান্ত প্রবাহমান। সেই অপপ্রচারের অংশ হিসেবে আমার বিরুদ্ধে এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। কেউ যদি এরূপ কিছু প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমি স্বেচ্ছায় কমিটি থেকে পদত্যাগ করব। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের সংগঠন দাবী করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পুর্ন মিথ্যা ও বানোয়াট।

এ ব্যাপারে শাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সামর্থের মধ্যে যতদূর সম্ভব প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড অনুসন্ধান করে কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছি। তারপরও কারো বিরুদ্ধে অন্য কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের অনেককে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সন্দেহের ভিত্তিতে বহিষ্কার করেছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

তবে শাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৮ মে সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে সভাপতি ও ইমরান খানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সেই হিসেবে তিন বছর দুই দিন পর শাখা ছাত্রলীগের এই কমিটি পূর্ণ রূপ পেল গত মঙ্গলবার। সব মিলিয়ে বিগত ১৪ বছরের মধ্যে এই প্রথম শাখা ছাত্রলীগ পেল পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত