রাবি প্রতিনিধি

২০ অক্টোবর, ২০১৮ ১৯:২৪

লিপু হত্যা: ২ বছরেও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপুর হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পেরোলেও আজ অবধি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কে বা কারা হত্যা করলো, কেন করলো, কারাই বা এর পিছনে রয়েছে পুলিশ সেসব বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি। এমনকি এর মধ্যে তিনবার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি মামলার অবস্থার।

লিপু হত্যা মামলা তদন্তের প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত নগরীর মতিহার থানার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা অশোক চৌহান দায়িত্ব নেওয়ার পর গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মামলার তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে, অল্পদিনের মধ্যে দোষীদের শনাক্ত করা যাবে। এর মধ্যে ওই বছরের ডিসেম্বরে অশোক চৌহান বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলে মামলার দায়িত্ব পান মতিহার থানার নতুন ওসি (তদন্ত) মাহাবুব আলম। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ আসে।

সিআইডিতে মামলাটির দায়িত্ব পান রাজশাহী সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক আসমাউল হক। তিনি পৌনে দুই বছর ধরে এই মামলার তদন্ত করলেও মামলাটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে ব্যর্থ হন। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তার বক্তব্য ছিল, ‘লিপু হত্যার তদন্তে এখনো কোন অগ্রগতি নেই। আসামি শনাক্তে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। আমরা তদন্ত করছি। একটু সময় লাগবে।’

তবে দুই বছরের মাথায় তিনি বলেন, ‘আমি তো ওখান থেকে বদলি হয়েছি। এ সংক্রান্ত আমার কোনো বক্তব্য নেই। এখন যে নতুন দায়িত্বে আছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

লিপু হত্যার ঘটনায় বিচ্ছিন্নভাবে গণমাধ্যমে ‘প্রক্সি চক্রের’ নাম জড়িয়ে খবর এলেও তা থেকে কোনো ‘ক্লু’ খুঁজে পায়নি পুলিশ। এমনকি তার রুমমেট মনিরুল ও ছাত্রলীগের খিচুড়ি পার্টি ধরে এগোলেও দুই বছরে এ মামলার কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

লিপুর বাবা, সহপাঠী ও শিক্ষকরা হত্যার বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে দুই বছরে শুধু হতাশা ও শঙ্কাই বেড়েছে। তারা এ মামলার তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

লিপুর বাবা বদরউদ্দীন বলেন, ‘এক বছর আগে ফোন দিয়েছিলাম এক পুলিশকে। তিনি বললেন, আমার কাছে এ মামলা নাই। তারপরে আর কোনো খোঁজ নেইনি। বুঝ না, এখন বিচার পাইতে হলে টাকা লাগে। আমার বাবা জানো তো, টাকা নাই। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি। তিনিই এর বিচার করবেন। আমার ছেলের নামে কোনো খারাপ রিপোর্ট ছিলো না। আমি তো আর কিছু জানতে চাইনি। আমি শুধু জানতে চেয়েছি, তারা আমার বাবারে কেনো মারলো?’

এদিকে লিপু হত্যার দুই বছরে বিচার দাবিতে শনিবার বেলা ১১টায় বিভাগের সামনে মানববন্ধন করেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন ও সঠিক বিচারের দাবি জানান।

মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি আল মামুন বলেন, ‘পুলিশের কাজ হলো একটা হত্যাকাণ্ডের পরপরই এর তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া। কিন্তু একটা হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পার হয়ে গেলো অথচ দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কোনো তদন্ত রিপোর্টই জমা দিতে পারলো না। এটা অবিশ্বাস্য, অগ্রহণযোগ্য। আমাদের মন ভার হয়ে আছে। দুই বছর পার হয়ে গেল! এখানে যারা দাঁড়িয়েছি তারা লিপুর সহপাঠী। তারা দেখেছে হলে লিপুর লাশ পড়ে আছে, লাশের গায়ে ক্ষত চিহ্ন আছে। যখন লাশে ক্ষত চিহ্ন থাকে তখন এটা কিলিং। এটা কোন সুইসাইডাল অ্যাটেম্পট না। এটা মার্ডার, যখন জানি এটা মার্ডার তার তদন্তে কেন দুই বছর লাগবে? এটা বড় প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম প্রশ্ন অনেক, অনেক ছাত্র-শিক্ষক মারা গেছে কিন্তু বিচার হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর কতদিন? বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন? আমাদেরকে কেন এই চর্চা চালিয়ে যেতে হবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও লিপুর সহপাঠী হুসাইন মিঠু বলেন, ‘এই মামলার তদন্তে আমরা পুলিশি অনীহা লক্ষ করেছি। পুলিশ চাইলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই এর প্রতিবেদন দিতে পারতো। পরবর্তী সময়ে সিআইডিতে মামলাটি গেলে তারাও পুলিশের মতোই এ মামলাটি নিয়ে অবহেলা করেছে। তারা আমাদেরকে হতাশ করেছে গত দুই বছর ধরে।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের লিপু ছিলেন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের ড্রেন থেকে লিপুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের দিন তৎকালীন রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার, পিবিআই, র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। লিপুকে হত্যা করা হয়েছিল বলে ওই সময় পুলিশ ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ওইদিন বিকেলে লিপুর চাচা মো. বশীর বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

মরদেহ উদ্ধারের দিন লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলামকে আটক করা হয়। তিনদিন পর হত্যা মামলায় মনিরুলকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু ৮ নভেম্বর জজকোর্ট থেকে মনিরুল জামিন পায়। জামিনের আগে মনিরুলকে চারদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে মনিরুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যার রহস্য উদঘাটন সম্ভব বলে তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা অশোক চৌহান দাবি করেছিলেন।

এক সপ্তাহ আগে লিপু হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া আজিজুর রহমান (ইন্সপেক্টর) বলেছিলেন, ‘আমি সপ্তাহখানেক হলো এ মামলার দায়িত্ব পেয়েছি। এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তবে মামলার তদন্ত চলছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত