রিপন দে

০২ অক্টোবর, ২০১৮ ১৭:১০

বিলুপ্ত হয়নি মিঠাপানির ঘড়িয়াল

ছবি: আদনান আজাদ আসিফ

বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাংলাদেশের মিঠাপানির প্রাণি ঘড়িয়াল। আশির দশকে বাংলাদেশের যমুনা পদ্মা ও মেঘনা নদীতে প্রচুর ঘড়িয়ালের দেখা মিলত কিন্তু ঘড়িয়ালকে ভয়ংকর প্রাণি ভেবে মানুষ নির্বিচারে মেরে ফেলায় ঘড়িয়াল এখন দেখা যায় না। এরা এখন মহাবিপন্ন প্রাণি।

আমাদের দেশে ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের সাথে মিলিয়ে বাংলাদেশেও ২০১৩ সালে কয়েকজন জীববিজ্ঞানী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে প্রাণিটি বিলুপ্ত হয়েছে।

অভিযোগ আছে, দেশী-বিদেশি কিছু গবেষক মাঠে কাজ না করে এবং সঠিক তথ্য না জেনেই প্রকাশ করেন ঘড়িয়াল বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তা যে ভুল ছিল তা প্রমাণ হয়েছে গত কয়েক বছরে এবং সর্বশেষ শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে যমুনা নদীতে মাছ ধরার সময় গভীর রাতে উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলে জেলেদের জালে একটি ঘড়িয়াল ধরা পড়ায়।

গবেষকরা বলছেন, যমুনা থেকে ধরা পড়া ঘড়িয়ালটির বয়স আনুমানিক ২ বছর। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে এখনো এরা বংশবিস্তার করছে।

এর আগে ২০১৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের পদ্মায় জেলেদের জালে ধরা আরেকটি ঘড়িয়াল। তবে ঘড়িয়াল বিলুপ্ত না হলেও তা অচিরেই হারিয়ে যাবার পথে। হয়ত আর কিছুদিন পরে এই ঘড়িয়াল শুধু ছবিতেই দেখা যাবে। অথচ নদীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঘড়িয়াল খুব প্রয়োজনীয়। মহাবিপন্ন প্রাণি হিসেবে ঘড়িয়াল ইতিমধ্যে লাল বইয়ে (Red Data Book of IUCN) নাম লিখিয়েছে, ঘড়িয়াল বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ধারনা করা হচ্ছে বাংলাদেশের খুবই সামান্য কিছু ঘড়িয়াল অবশিষ্ট আছে।  
 
ঘড়িয়ালের ইংরেজি নাম: Gharial বা Gavial বৈজ্ঞানিক নাম: Gavialis gangeticus। শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ঘড়িয়াল বিলুপ্তির পথে।

মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশ থেকে এই প্রাণিটি বিলুপ্ত হচ্ছে। এর পেছনে বড় একটি কারণ হচ্ছে আমাদের জেলেরা অসচেতন তাই যখন তাদের জালে ঘড়িয়াল আটকা পড়ে তারা পিঠিয়ে মেরে ফেলে। কারণ তাদের ধারনা যেহেতু ঘড়িয়াল দেখতে কুমিরের মত তাই হয়ত তারা কুমিরের মত ভয়ংকর অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ঘড়িয়ালরা মানুষখেকো হওয়া তো দূরের কথা, এগুলো মানুষের ধারে-কাছেও পারতপক্ষে ঘেঁষে না। এর কারণ ঘড়িয়াল শুধু মাছ, সাপ, ব্যাঙ ছাড়া অন্যকিছু খায় না। এভাবে ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক ঘড়িয়ালকে জেলেদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে যা তাদের বিপন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশের ঘড়িয়াল কমে যাবার আরেকটি কারণ প্রজনন না করতে পারা। কারণ ঘড়িয়াল মিঠা পানির প্রাণি হলেও প্রজননকালে ডিম পাড়ে চড়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশের চড়ে উঠে ডিম পাড়লেও ঘনবসতির কারণে নদী থেকে পাড়ে উঠে থাকতে পারছে না। কখনো মানুষের হাতে মারা পড়ে আবার কখনো মানুষ তাদের ডিম নষ্ট করে ফেলে এবং কুকুর এবং শিয়াল ডিম খেয়ে ফেলে যা তাদের বংশবিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
 
পুরুষ ঘড়িয়ালের ওপরের চোয়ালে, নাকের ঠিক ওপরে, কলস বা ঘড়া আকৃতির একটি পিণ্ড থাকে। লম্বা চোয়ালটি বাদ দিলে এরা দেখতে অন্যান্য কুমিরের মতোই। এদের চোয়াল ০.৯-১.২ মিটার লম্বা। চোয়ালে দাঁত আছে ১০৬ থেকে ১১০টি।

মাছ এদের প্রধান খাদ্য। আঁশবিহীন মাছ, বিশেষ করে বোয়াল, আইড়, গুঁজি, পাঙাশ বেশি পছন্দ করে এরা। লম্বা চোয়াল মাছ ধরার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।

বালুচরে রোদ পোহাতে এরা বেশ পছন্দ করে। রোদ পোহানোর সময় সাধারণত বিশাল হাঁ করে থাকে। যদিও এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু মানুষ এদের ক্ষতি করতে মোটেও ছাড়ে না। অনেকটা মেরে ফেলতে পারলেই যেনো আনন্দ পায়।

চৈত্র মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু। এ সময় স্ত্রী ঘড়িয়াল বালুতে ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ গর্ত করে একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০টি ডিম পাড়ে। এরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচে।

একটি নদীকে তখনই সুস্থ এবং স্বাভাবিক বলা যাবে যদি সেখানে ঘড়িয়ালের উপস্থিতি পাওয়া যায়। নদী এবং পরিবেশের জন্য উপকারী অবশিষ্ট ঘড়িয়ালদের বাঁচাতে হলে এবং আমাদের দেশে এদেরকে শুধু ছবির ফ্রেমে না দেখতে হলে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি প্রাণি অজানা থেকে যাবে।

২০১০ সালে Gharial Conservation in Bangladesh এর উদ্যোগে ঘড়িয়াল নিয়ে একটি প্রজেক্ট চালু করেছিলেন রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোল্লা রেজাউল। তিনি জানান, বদলি হওয়ার কারণে আমি আমার প্রজেক্ট চালিয়ে যেতে পারিনি। তবে ধারনা করেতে পারছি এখনো দেশে প্রায় ৪০টি ঘড়িয়াল টিকে আছে। পদ্মা নদীর রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী, চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, যমুনা নদীর চর উত্তর কোন্নাবাড়ি ও চর খিজিরপুরকে ঘড়িয়ালের জন্য সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করলে তা তার বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। সেই সাথে এই সব নদীর জেলেদের সচেতন করতে হবে।
 
এ বিষয়ে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ও প্রাণী গবেষক আদনাদ আজাদ আসিফ বলেন, সারা দুনিয়াতে ঘড়িয়াল মানুষকে আক্রমণ করেছে এমন নজির নেই। এরা শুধু মাছ খায়। তাই মানুষকে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। উদ্ধার করা ঘড়িয়ালটির ছবি দেখে মনে হল এর বয়স ২ বছরের বেশি হবে। এতে করেই বোঝা যায় ঘড়িয়াল আমাদের দেশে এখনও প্রজনন করছে আমাদের উচিত কিছু সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে গণসচেতনতা বাড়ানো ও স্থানীয় মাঝিদের প্রচুর কাউনসেলিং করা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেটা ভুল ধারনা। নদীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঘড়িয়ালকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেহেতু এ দেশে এরা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী, তাই তাদের রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এ জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রকৃতি ও প্রাণি সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে। এছাড়া জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঘড়িয়ালের বেঁচে থাকা দরকারি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত