জাকির আজিজ

০৫ জুন, ২০১৬ ১২:০৫

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাহসী অভিযানের কারণেই কি এসপি বাবুলের স্ত্রী খুন?

রোববার সকালে অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসীদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে নিহত মাহমুদা আক্তার মিতু পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত পুলিশ সুপার ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী।

মাহমুদা আক্তারের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে  পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), চট্টগ্রাম প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির আহমেদ খান বলেন, ‘সকাল ৬টা ৩৫ মিনিট দিকে বাসা থেকে ১০০ গজ দূরে ছেলেকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে যাওয়ার পথে তিনজন মোটর সাইকেল আরোহী তাকে ধাক্কা দেন। এরপর তারা ছুরিকাঘাত করে পরপর তিন রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। ছুরিকাঘাতের পাশাপাশি মাহমুদা আক্তারের মাথার বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।’

তিনি আরো বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ধরন ও পূর্বের জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে এটির হুবহু মিল রয়েছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ধারণা করছি জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড সাথে জড়িত। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। খুনিদের ধরতে অভিযান চলছে।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার। এসময় তিনি হত্যাকাণ্ডের সাথে জেএমবি জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান। প্রাথমিকভাবে তিনিও এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জঙ্গিরা জড়িত বলে মনে করছেন।

নিহত মাহমুদা আক্তার মিতুর স্বামী এসপি বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সাহসিক অভিযানের কারণে দেশব্যাপী তুমুলভাবে আলোচিত ছিলেন, পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

গত বছর চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদে শেরশাহ ন্যাংটা ফকিরের মাজারে ঢুকে কথিত পীরসহ দু’জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর ঈদুল আজহার আগের দিন সদরঘাট বাংলাবাজার এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণের দুই ছিনতাইকারী ও এক ব্যবসায়ী নিহতের আরেকটি ঘটনা ঘটে। দুটোই দেশব্যাপী আলোচিত হয়।

অপরাধ দমনে আলোচনায় থাকা বাবুল আক্তার আলোচনায় আসেন গত বছর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোঁয়জনগর এলাকার একটি ভবনের নিচ তলায় জেএমবি আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে। যেখানে তিনি গ্রেনেড হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান। সেখানে তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেডও ছুড়ে মেরেছিল নিহত জঙ্গি নেতা জাবেদ। ভাগ্যক্রমে বাবুল বেঁচে গেলেও জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হন তিনি।

এছাড়া গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাটহাজারীর আমান বাজারের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জেএমবি নেতা ফারদিনের বাসা থেকেও বিপুল বিস্ফোরক ও অত্যাধুনিক স্নাইফার রাইফেল উদ্ধার করে আলোচনায় ছিলেন তিনি।

উল্লেখ্য, এসপি বাবুল আক্তার গত বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সিএমপি ছেড়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদানের জন্য ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেন।

বাবুল আক্তার পুলিশে যোগ দেন ২০০৫ সালে। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র‌্যাব-২-এ কর্মজীবন শুরু। যোগদানের পরের বছর পুলিশ কর্মকর্তা পুরান ঢাকা থেকে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার জাল সনদ, সনদ তৈরির কারখানা এবং এই অপকর্মের হোতাদের আটক করেন।

২০০৭ সালে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলেন 'ভয়ংকর' ছয় খুনের রহস্য উন্মোচনের দায়। নরসিংদীর ভেলানগরে সে বছরের ১৮ মে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে। একই পরিবারের ছয় সদস্যকে খুন করে ঘরের ভেতরেই লাশগুলো বস্তাভর্তি করে রাখা হয়েছিল চার দিন। ঘটনার তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চান র‌্যাব অফিসার বাবুল। অনুমতি পাওয়ার পর শুরু হয় বাবুলের অভিযান। ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ঘুরে গ্রেপ্তার করেন বীরুকে। তার সূত্র ধরে পুরো হত্যারহস্য উন্মোচন করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। মামলার বিচার শেষে আসামিদের ফাঁসির রায় দেন আদালত।

এ ছাড়া স্কুলশিক্ষিকা তানিয়া হত্যারহস্য উদ্ঘাটন; ১৪ বছরের কিশোর জাভেদকে অহরণকারীদের হাত থেকে অক্ষত উদ্ধার ও অপহরণরহস্য উদ্ঘাটন; গৃহকর্মী রুমাকে হত্যার পর পুড়িয়ে সব আলামত নষ্টের পরও সূত্রহীন সেই হত্যাকাণ্ডের সূত্র উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেপ্তার; রাউজানের বেসরকারি ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা চুরির হোতা গ্র্যাজুয়েট চোরচক্রকে গ্রেপ্তার; চট্টগ্রামের ভয়ংকর ডাকাত সর্দার খলিলকে ৯ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার ও মালামাল উদ্ধার, অজ্ঞান- মলমপার্টি- মোটরসাইকেল চোরচক্র গ্রেপ্তার, ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রকেট লঞ্চার, ছয় অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার, দুর্ধর্ষ ক্যাডার বিধান বড়ুয়ার কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল উদ্ধার; চট্টগ্রামের কাদের ডাকাত ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার ত্রাস কিলার ওসমানকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করেছেন বাবুল আক্তার।

সিএমপিতে যোগ দিয়েই সর্বশেষ পুলিশ মার্ডার মামলার আসামি গ্রেপ্তার ও খুনের কাজে ব্যবহৃত 'কাটনি' উদ্ধার করে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। আর এসব সাফল্যের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে পেয়েছেন স্বীকৃতি- রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা) (২০০৮), ২০০৯ পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসিকতা)। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেছেন বাবুল আক্তার। আর এর মধ্যে চার-চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের মর্যাদা।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে রাজারবাগ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কার তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্তে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বাবুল আক্তারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, 'বাবুল আমাদের সবচেয়ে সাহসী অফিসার।' শুনে প্রধানমন্ত্রী বাহবা দিলেন।

বাবুল আক্তার দ্বিতীয় দফা স্যালুট দিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী বাবুলের বুকে পরিয়ে দিলেন 'বিপিএম' মেডেল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত