সিলেটটুডে ডেস্ক

০৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০২:০৬

যেসব কারণে হাওলাদারকে বাদ দিলেন এরশাদ

ঘোষণাটা আকস্মিক, সোমবার দুপুরেই সব গণমাধ্যমে পাঠানো হয় বার্তা। জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদ থেকে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে দিয়েছেন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

তার জায়গায় নতুন করে মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে, যিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।

অবশ্য এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রীর মহাসচিব থেকে সরিয়ে দেয়া এই প্রথম নয়। তিনি ২০০২ সালে প্রথম দলের মহাসচিব হন। এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিলে তাকে অব্যাহতি দেন এরশাদ। তখন জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেন। এর দুই বছর পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রুহুল আমিন হাওলাদারকে আবারও মহাসচিব নিযুক্ত করেন এরশাদ।

রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে দেয়ার পরই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনলেন এরশাদ?

দলটির নেতারা সরাসরি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির শীর্ষ একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ৫টি কারণে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম মনোনয়ন বাণিজ্য। এ ছাড়া মহাজোটের সঙ্গে আসনবণ্টনে দর কষাকষিও রয়েছে। নিচে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে দেয়ার কারণগুলো দেয়া হলো—

১. মনোনয়ন বাণিজ্য

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও বেশ পুরনো। তবে সম্ভবত এবারই প্রথম মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মুখ খোলেন। তারা এজন্য বনানীর কার্যালয়ে হাওলাদারকে অবরুদ্ধও করে রাখেন। সেখানে হাওলারপন্থীদের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এটি ভালভাবে নেননি পড়ন্ত বয়সে আসা চেয়ারম্যান এরশাদ। এসব বিষয় সামাল দিতে না পারায় তিনি হাওলাদারকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে।

২. আসনের দর কষাকষিতে ব্যর্থ

জাতীয় পার্টি এককভাবে সারা দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি বেশ জোরেশোরেই রেখেছিল। এরশাদ তো আরও দু’বছর আগে থেকে বলে আসছিলেন, এককভাবে নির্বাচন করব। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। তবে মনোনয়ন চিঠি ইস্যুর আগ মুহূর্তে সব পাল্টে যায়। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি, তাদের জোট ২০ দল এবং নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয়। এরপরই জাপা আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে একাধিকবার আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেও মনঃপুত আসন পায়নি দলটি। তারা চেয়েছিল ৭০-৮০টি আসন। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরাসরি ৩৫টি আসন দেয়া কথা জানায়। এতে করে তৃণমূলে ক্ষোভ দেখা দেয়। এরশাদ দর কষাকষির ব্যর্থতা রুহুল আমিন হাওলাদের ঘাড়েই চাপিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শীর্ষ নেতা পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন।

৩. বাবলুর মনোনয়ন

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবুল জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা এবং এরশাদের ঘনিষ্ঠ। প্রেসিডিয়াম এই সদস্যকে একবার দলের মহাসচিবের দায়িত্বও দিয়েছিলেন তিনি। এরশাদ এবার তাকে চট্টগ্রাম থেকে মহাজোটের প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হওয়ায়, রুহুল আমিন হাওলাদার আওয়ামী লীগের সঙ্গে এটি নিয়ে দর কষাকষিতে ব্যর্থ হন। বাবলুর পছন্দের আসনে আওয়ামী লীগ প্রয়াত চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এবিএম মহীউদ্দীন চৌধুরীর ছেলে সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে মনোনয়ন দেয়।

বাবলুকে কক্সবাজারে মনোনয়ন দেয়া হয়। সেখানেও তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা কলা গাছ মিছিল করেন। এমনকি বাবলুর গাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটে। পরে রংপুরের একটি আসনে বাবলুকে প্রার্থী করা হয়। এটি নিয়ে এরশাদ রুহুল আমিন হাওয়াদারের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন।

এ বিষয়ে জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘স্যার (এরশাদ) বাবলুকে চট্টগ্রামে মহাজোটের প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সেটি আদায় করতে ব্যর্থ হন হাওলাদার। পরে বাবলুর গাড়িতে হামলাও হয়। এসব ঘটনায় এরশাদ মহাসচিবের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’

৪. এরশাদের ভাবমূর্তি রক্ষা

দল পরিচালনায় এরশাদকে বলা হয় ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ক্যারেকটার। বউ-বান্ধবী নিয়েও তার বিরুদ্ধে সমালোচনা-আলোচনা কম নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে তিনি যা করেছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন, তা সব কিছুকেই হার মানায়। এরপর থেকে বলা হয়, এরশাদের নির্বাচনী রোগ, যেটি তিনি এবারও শুরু করেছেন। সম্ভবত এই শেষ বয়সে এসে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তিনি মেনে নিতে পারেননি। বিতর্ক এড়াতেই সবকিছুর জন্য মহাসচিবকে দায়ী করে তাকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

৫. হাওলাদারের ‘স্ত্রী ফ্যাক্ট’

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে এরশাদ। এ সময়ে রুহুল আমিন হাওলাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি থেকে মহাজোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। তিনি নিজের ও স্ত্রী সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রত্নার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে সফল হন।

তবে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-১ আসনের বর্তমান এমপি সালমা ইসলামসহ দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হন মহাসচিব। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে সালমা ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আর উত্তরাঞ্চলে আরেক প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি আবদুর রশীদ সরকার বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন।

সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এরশাদ এসব জেনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারই বহিঃপ্রকাশ তিনি মহাসচিবকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে করেছেন বলে জানা গেছে।

যদিও এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির কোনো নেতা সরাসরি মুখ খোলেননি। স্বয়ং নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি।

তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘চেয়ারম্যান (এরশাদ) রুহুল আমিন হাওলাদারকে অব্যাহতি দিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা সবাই তার আদেশ মানতে বাধ্য।’

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘কেন মহাসচিবকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, আমি বলতে পারব না। তবে তিনি যেটি ভাল মনে করেছেন, সেটিই করেছেন। আমরাও তার এই সিদ্ধান্ত মেনে চলব।’

এ বিষয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারের ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে তার স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্না স্বামীর বিরুদ্ধে আনা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘দলের প্রয়োজনেই চেয়ারম্যান (এরশাদ) মহাসচিব পরিবর্তন করেছেন। এই এখতিয়ার উনার আছে। আমরা তার সিদ্ধান্ত মেনে চলব।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত