সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

১৮ নভেম্বর, ২০১৮ ১৬:৫০

ভাসানী গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র ৪২ তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালন উপলক্ষে সিলেটে জাতীয় ছাত্রদল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও সিলেট জেলা শাখার যৌথ উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শনিবার (১৭ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর সুরমা মার্কেটস্থ সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ছাত্রদল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রামকৃষ্ণ দাস।

আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা শাখার সাবেক আহবায়ক ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শাহীন আলম, জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা শাখার সাবেক সভাপতি মামুন আহমেদ খান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. ছাদেক মিয়া। সভার শুরুতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র রাজনৈতিক জীবনের ওপর লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় ছাত্রদল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক জ্যাম চাকমা।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, মওলানা ভাসানী অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি সারা জীবন খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা বলে গিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও জোতদার মহাজনদের সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী’র ‘খামোশ’ উচ্চারণে তখনকার শাসকদের মসনদ কেঁপে উঠত।

বক্তারা বলেন, আমরা এমন এক সময় আজ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি যখন দেশ এক গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক সংকটে জর্জরিত। অথচ মহাজোট সরকার উন্নয়নের কথা বলে গলা ফাটিয়ে চলেছে। মহাজোট সরকার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা এসডিজি বাস্তবায়নে ১৭টি লক্ষ্যের অন্যতম অবকাঠামো নির্মাণ করে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি লগ্নি করার জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতাকে উন্নয়ন বলে চালাচ্ছে। অথচ এই ঋণের বোঝা চাপানো হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে। বর্তমানে এই ঋণ মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার নির্মম শোষণ অব্যাহত রেখে দুর্নীতি করে বেপরোয়া লুটপাট চালিয়ে দালালপুঁজি স্ফীত করার অপতৎপরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ থেকে শত শত কোটি ডলার লুট হওয়া, ভল্টে থাকা সোনা পাল্টে যাওয়া; ব্যাংকে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া, ব্যাংক দেউলিয়া হওয়াসহ ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে। সর্বগ্রাসী লুটপাটের টাকা জমা হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি বিশেষের নিকট। নজিরবিহীনভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশের অতিধনীদের (যাদের সম্পদ ৩ কোটি ডলারের বেশি) সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৫ বছরে উন্নত বিশ্বের সব দেশকে পেছনে ফেলে ১৭.৩ শতাংশ হারে বাংলাদেশের অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের সিংহভাগ এসব লুটেরাদের নিকট জমা হচ্ছে। বিপরীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। নি:স্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে দেশের শ্রমিক কৃষকসহ অধিকাংশ জনগণ। দেশে শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন; প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশী অভিযান এবং মিথ্যা আশ্বাস কৌশলের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন কালা কানুন তৈরি করে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

বক্তারা আরো বলেন, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পুঁজি ও শক্তি অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় বণ্টন-পুনর্বন্টন ও সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে দেশে দেশে একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ প্রেক্ষিতে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানীয়যুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। মহাজোট সরকারের জাতিসংঘের ‘এসকাপ’ পরিকল্পনায় বৈদেশিক ঋণে অবকাঠামো নির্মাণ তৎপরতার অন্যতম দিক হচ্ছে নয়াউপনিবেশিক ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বাত্মক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য করিডোর কার্যকরী করে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ আমলের এতদ্বাঞ্চলে যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আবার বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীনের ‘(বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মায়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোর’ এবং ভারতের ‘উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা’ কার্যকরী করার প্রতিযোগিতায় মহাজোট সরকার উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা নিচ্ছে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে শাসক-শোষক শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত এই বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিকে আরো বৃদ্ধি ও তীব্রতর করছে। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব আজ একই সাম্রাজ্যবাদের এক দালালের পরিবর্তে আরেক দালালের, হাসিনার পরিবর্তে খালেদার, মহাজোটের বদলে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং তা এক সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে আরেক সাম্রাজ্যবাদের তথা মার্কিনের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীনের নেতৃত্বে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র, সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও নয়াউপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী ভারতের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা হিসেবে সামনে আসছে। বাংলাদেশে মার্কিনের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে প্রতিপক্ষের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংঘাত ও যুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, আসামে ৪০ লক্ষ বাঙ্গালীর ভারতীয় নাগরিকত্ব সমস্যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করছে।

দেশ-জাতি-জনগণের এই কঠিন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী দল বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট জনগণ ও জাতীয় জীবনের জরুরী সমস্যা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করছে না। প্রভুর আশীর্বাদ নিয়ে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটের জন্য তারা বেশি তৎপর। সম্প্রতি নির্বাচনকে সামনে রেখে সুবিধাবাদী-সংশোধনবাদী, এনজিও মার্কা কয়েকটি বাম নামধারী দল মিলে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ গঠন করেছে। তারা মূলত: চীনের পরিকল্পনা ও স্বার্থ বাস্তবায়নে তৎপর। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট মিলে বৃহত্তর ঐক্যের নাম দিয়ে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা মূলত সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ একটি নয়া উপনিবেশিক দেশ হওয়ায় শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রতিটি সরকারই অনেক জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে যা সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। ক্ষমতায় আসা বা টিকে থাকার জন্য আমাদের দেশের সরকারগুলো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে চলে। রামপুর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন চুক্তি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই করা হচ্ছে। তাই আজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক শক্তিকে জাতীয় ও জনস্বার্থ বিরোধী সকল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অপতৎপরতা রুখে দাঁড়াতে হবে। অগ্রসর করতে হবে সকল সাম্রাজ্যবাদ ও দালালদের সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালাল পুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। মওলানা ভাসানীর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা দালালপুঁজিকে উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে তিনি কাজ করে গেছেন। মওলানা ভাসানীর আজীবন লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালালপুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বেগবান করার মধ্য দিয়েই মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।

জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম আহবায়ক নাজমুল হাসানের পরিচালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় ছাত্রদল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রুপেল চাকমা, সাংঘঠনিক সম্পাদক সৌরভ ঘোষ, জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা শহর পূর্বাঞ্চল কমিটির আহবায়ক আ. সালাম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত