সিলেটটুডে ডেস্ক

১৮ মে, ২০১৬ ১৪:২৭

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার নামে প্রতারণা, ভুয়া ওয়েবসাইটের ফাঁদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা গ্রিন কার্ড ভিসার প্রলোভন দেখিয়ে একটি ভুয়া ওয়েবসাইট খুলে বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদনপত্র নেওয়া হচ্ছে। পরে প্রত্যেক আবেদনকারীর কাছ থেকে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড ও বিকাশের মাধ্যমে ৯ দশমিক ৯৯ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ৭৯৬ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওয়েবসাইটটির মালিকপক্ষ।

সেই ওয়েবসাইটের নাম গ্রিন কার্ড ভিসা ডট ইউএস (www.greencardvisa.us)। ওয়েবসাইটে ‘গ্রিন কার্ড ভিসা প্রোগ্রাম-২০১৭’ নামে একটি কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬-১৭ সালে চার হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে ‘ফ্রি ইমিগ্র্যান্ট ভিসা’ দেওয়া হবে। এ জন্য দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকেরা আবেদন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমের মাধ্যমে আবেদন করার পরে ৭৯৬ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তারপর লটারির মাধ্যমে গ্রিন কার্ডের জন্য বাছাই করা হবে। শেষে বিজয়ীদের একটি অভিনন্দনপত্র ও চিঠি দেওয়া হবে। সেই চিঠি ও পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে নির্দিষ্ট সময় আমেরিকান দূতাবাসে সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে হবে।
ওয়েবসাইটে দেখা যায়, আবেদনের জন্য আরও ১৯ দিন সময় আছে।

বেশ চটকদার করে সাজানো ওয়েবসাইটে গ্রিন কার্ড ভিসা প্রোগ্রাম বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া আছে। একই সঙ্গে কিছু তথ্যের বিস্তারিত জানার জন্য ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটের লিংক দেওয়া আছে। ফলে চট করে দেখলে পুরো বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়। তবে লিংকগুলো পড়লে দেখা যায়, সেগুলোর সঙ্গে এই প্রোগ্রামের কোনো ধরনের মিল নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার প্রলোভন দেখিয়ে লোক ঠকানোর জন্যই ওয়েবসাইটটি খোলা হয়েছে। মার্কিন দূতাবাস ও যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নিজস্ব ওয়েবসাইট ঘেঁটে ওই ভিসা প্রোগ্রামের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। লটারির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য ডাইভারসিটি ভিসা (ডিভি) প্রোগ্রাম বাংলাদেশিদের জন্য ২০১২ সাল থেকে বন্ধ আছে।

লটারির মাধ্যমে কথিত গ্রিন কার্ড ভিসার জন্য ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন ও টাকা পরিশোধ করতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের একটি পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের প্রয়োজন হয়। সেই ক্যাশ কার্ড করতে বিভিন্ন ডাকঘরে মানুষ ভিড় করছেন। ক্যাশ কার্ড হলো টাকা লেনদেনের একটি মাধ্যম।

সিলেটের প্রধান ডাকঘর থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটিও পোস্টাল ক্যাশ কার্ড বিক্রি হয়নি। মার্চে বিক্রি হয় ১৩টি। তবে গত মাসে হঠাৎ করেই বিক্রি বাড়ে। সব মিলিয়ে এপ্রিল মাসে ৬৭১টি কার্ড বিক্রি হয়। আর চলতি মাসে গত রোববার বেলা তিনটা পর্যন্ত ৪৬৩টি ক্যাশ কার্ড বিক্রি হয়।

সিলেট প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্টমাস্টার আবু সাঈদ বলেন, সম্প্রতি ক্রয় করা পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকেরা কয়েকটি নির্দিষ্ট নম্বরে আট শ টাকা করে পাঠাচ্ছেন। এসব নম্বরের মধ্যে ৭০০৯০১৩০০০২৪৯৮০৮৬৩, ৩২৭৫২৫৯৩ ও ৬৩২৯৯৮২৯ উল্লেখযোগ্য।

গত রোববার সিলেটের প্রধান ডাকঘরে গিয়ে নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা খায়রুল মিয়া নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, লটারির মাধ্যমে আমেরিকান গ্রিন কার্ড দেওয়া হবে—এমন তথ্য একটি ওয়েবসাইটে আছে। তাঁর এক আত্মীয় সেই ফরম পূরণ করবেন। সে জন্য তিনি কার্ড কিনতে এসেছেন।

যেসব নম্বরে টাকা পাঠানো হচ্ছে, সে সম্পর্কে জানতে ঢাকার জিপিওতে খোঁজ নেওয়া হয়। সেখান থেকে জানানো হয়, ২৪৯৮০৮৬৩ ও ৩২৭৫২৫৯৩ নম্বরের কার্ড দুটি যথাক্রমে মিরাজ হোসেন ও উজ্জ্বল কান্তি সরকারের। তবে উভয় কার্ডের আবেদন ফরমে একই ব্যক্তির ছবি দেওয়া আছে। উভয় ক্ষেত্রে ঠিকানা, পেশা ও মোবাইল নম্বর ভিন্ন দেওয়া হয়েছে। তবে মিরাজ হোসেন নামের ক্যাশ কার্ডের ফরমের সঙ্গে একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আছে। সেখানে মিরাজের ঠিকানা উল্লেখ আছে মধুখালী, ফরিদপুর। তাঁর পিতার নাম রুস্তম শেখ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল জাকির হাসান নূর বলেন, ‘গত মাসে সিলেটের পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের বাড়তি চাহিদার কথা জানার পর আমাদের সন্দেহ হয়। তখন ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝতে পারি, বিষয়টি ভুয়া। এটি নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা চারটি কার্ডের লেনদেন বন্ধ করে দেই। এসবে ৭ হাজার ৬৭৩ টাকা জমা আছে। তবে উজ্জ্বল কান্তি সরকার নামে ইস্যু করা কার্ডটির লেনদেন বন্ধ করার আগেই ১৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।’

একইভাবে ডাক বিভাগের মোবাইলে অর্থ পাঠানোর সেবা ইএমটিএসের মাধ্যমে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা সন্দেহজনক হওয়ায় সেটির লেনদেনও বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানান জাকির হাসান নূর। তিনি বলেন, ‘অনেক গ্রাহক আমাদের কাছে ওয়েবসাইটটির বিষয়ে জানতে চেয়ে ফোন করেছে। আমরা তাদের বলেছি, এটি ভুয়া। টাকা না পাঠাতে পরামর্শ দিয়েছি। তবে কেউ কেউ বলেছে, ভুয়া হলে হবে। মাত্র ৮০০ টাকাই তো।’

জাকির হাসান নূর বলেন, ‘সিলেটের মতো চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে একইভাবে পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের বিক্রি গত মাস থেকে হঠাৎ করেই বেড়েছে। আমাদের অনুসন্ধান বলছে, আমেরিকার ভিসার ভুয়া আবেদন করার জন্যই এমনটা হচ্ছে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইট-সম্পর্কিত নানান ধরনের তথ্য দেয় ডব্লিউএইচও ডট আইএস (who.is)। ওয়েবসাইটটি থেকে জানা যায়, গ্রিন কার্ড ভিসা ডট ইউএস নামের ওয়েবসাইটের ডোমেইন গত ১১ মার্চ নিবন্ধিত হয়। ‘ইউএস ভিসা কাউন্সিল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মিরাজ হোসেন এই ওয়েবসাইটের মালিক। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের একটি ঠিকানা ব্যবহার করে এটি করা হয়েছে।

মিরাজ হোসেন ক্যাশ কার্ড কেনার সময় যে ফোন নম্বর দিয়েছিলেন, সেটিতে গতকাল কয়েকবার ফোন করলেও কেউ তা ধরেনি। অন্যদিকে উজ্জ্বল কান্তি সরকারের নামে কেনা কার্ডের নম্বরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সূত্র : প্রথম আলো

আপনার মন্তব্য

আলোচিত