সিলেটটুডে ডেস্ক

১৫ জুন, ২০২৩ ১৮:০১

নির্মলেন্দু চৌধুরীর শতবর্ষের অনুষ্ঠানে সিলেটের লোকসংগীত শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী

বাংলার লোকগানকে দীর্ঘ একটা সময় ধরে গ্রাম থেকে শহরে, দেশ থেকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি লোকগানের শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী। চল্লিশের দশকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে যাঁরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী।

গণনাট্য আন্দোলন ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কবি, সুরকার ও সংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান পরিবেশন করে গণসংগীত ও লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। হয়ে ওঠেন গণনাট্য আন্দোলন সিলেটের মধ্যমণি।

নির্মলেন্দু চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ সালে সুনামগঞ্জের সুখাইর গ্রামে। শৈশব থেকেই গানের প্রতি অনুরাগ। সংগীতানুরাগী বাবা-মা চাইতেন ছেলে শিল্পী হয়ে উঠুক। তাঁদের কাছেই নির্মলেন্দু গান শেখার প্রেরণা পান। লোকসংগীতর সুর তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতো। তন্ময় হয়ে শুনতেন নদীতে নৌকা বেয়ে চলা মাঝির গান।

নির্মলেন্দু চৌধুরী গানে প্রাথমিক তালিম নিয়েছেন ময়মনসিংহের খ্যাতিমান শিল্পী আবদুল মজিদ ও আবদুর রহিমের কাছে। এঁদের কাছে তিনি দোতারা বাজানো শেখেন। পরবর্তী সময়ে শান্তিনিকেতনে অশোকবিজয় রাহার কাছে রবীন্দ্র সংগীত তালিম নেন।
রবীন্দ্র ভারতীতে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। গাইতেন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির গান। পল্লীগীতি অর্থাৎ মাটির এই গানকে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওয়ারশতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে লোকগীতি পরিবেশন করে স্বর্ণপদক লাভ করেন নির্মলেন্দু চৌধুরী।

ছায়াছবিতে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। লং প্লে রেকর্ডে তিনি পরিচালনা করেন ‘মলুয়া’ গীতিনাট্য। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ নামে একটি গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল প্রয়াত হন শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী।

তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে মাটির সুর মুগ্ধ করত শ্রোতা ও দর্শকদের। শিল্পীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘‌লোকভারতী’‌র আয়োজনে কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে গত ৩ ও ৪ জুন ২০২৩ শনিবার এবং রোববার নির্মলেন্দু চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানটি হয়।

দু’‌দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘‌নির্মলেন্দু চৌধুরী লোক–উৎসব’‌। অনুষ্ঠানে কথায়–গানে স্মরণ করা হল শিল্পীকে।

অনুষ্ঠান সহযোগিতায় ছিল অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ শ্রীহট্ট সম্মিলনী। দুইদিনের এই উৎসবের প্রদীপ জ্বালিয়ে সূচনা করেন প্রবীণ বাউল সম্রাট পদ্মশ্রী পূর্ণ চন্দ্র দাস বাউল।

উপস্থিত ছিলেন লোকসংগীত শিল্পী গীতা চৌধুরী, প্রাক্তন নগরপাল সুরজিৎ করপুরকায়স্থ, পিয়ারলেসের এএমডি ড.‌ সুজিত কর পুরকায়স্থ, রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দেব, অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ শ্রীহট্ট সম্মিলনীর সহ–সভাপতি প্রদোষরঞ্জন দে এবং লোকভারতীর সভানেত্রী উত্তরা চৌধুরী, লোক ভারতীর সভাপতি উত্তরা চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক বাপ্পু এন্দ।

লোকসংগীত এবং লোকসংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য এবারের নির্মলেন্দু চৌধুরী সম্মাননা প্রদান করা হল বাউল সম্রাট পূর্ণদাস বাউল, লোকসংগীত শিল্পী গীতা চৌধুরী, শিবব্রত কর্মকার ও শঙ্কর চৌধুরীকে। দু’‌দিনে তাঁদের হাতে সম্মান ও স্মারক তুলে দেন উত্তরা চৌধুরী।

লোকসংগীত প্রচার ও প্রসারের জন্যই লোকভারতী সংস্থা স্থাপন করেছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুর পর সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যান পুত্র লোকসংগীত শিল্পী উৎপলেন্দু চৌধুরী। তাঁর অকালমৃত্যুর পর লোকভারতীর কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন স্ত্রী উত্তরা চৌধুরী। বর্তমানে লোক ভারতীর সভাপতি হলেন উত্তরা চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক বাপ্পু এন্দ।

অনুষ্ঠানের সংগীতপর্বের সূচনা দক্ষিণ কলকাতার সিলেট অ্যাসোসিয়েশনের লোকগানের দল শ্রীভূমির পরিবেশনায় ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’‌ গানে।

দু’‌দিনের লোকউৎসবের শেষ দিনে দুই বাংলার অনেক নামীদামী শিল্পীদের সাথে সংগীত পরিবেশন করেন দুই বাংলার জননন্দিত সংগীত শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী। তিনি শাহ আবদুল করিমের বন্দে মায়া লাগাইছে এই গানটি পরিবেশন করেন এবং পরবর্তীতে আরকুম শাহ'র আজি দরশন মিলন গানটি তার সাথে দ্বৈত পরিবেশনায় অংশ নেন আসামের বরাক উপত্যকার আরেক জননন্দিত শিল্পী শ্রীযুক্তা সর্বানী ভট্টাচার্য। তিনি গানের সাথে তার কথামালায় বলেন -সিলেট জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, আন্দোলন-সংগ্রাম এক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে। রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, শীতালং শাহ, দুরবীন শাহ প্রমুখের গীত রচনা এই অঞ্চলের লোকসংগীতের ভাণ্ডারকে যেভাবে সমৃদ্ধ করে, ঠিক সেভাবে সৃষ্টি করে নবজাগরণ। এখানকার পল্লিগাঁয়ের মানুষের নিজের মনের কথা উঠে আসে প্রখ্যাত গীতিকবিদের রচনায়। এসব কালজয়ী গানকে আবালবৃদ্ধবনিতা কণ্ঠে ধারণ করে নিজের মতো।দেশীয় পরিমণ্ডলে গ্রামবাংলার এই গানকে মানুষের মুক্তির সোপান রচনায় কাজে লাগাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। উল্লেখ্য জননন্দিত সংগীতশিল্পী গৌতম চক্রবর্তী সিলেটের ছেলে এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ওপার বাংলার প্রখ্যাত বাউল শিল্পী বাউল সম্রাট পূর্ণদাস বাউলের একনিষ্ঠ শিষ্য।

নির্মলেন্দু চৌধুরীর শতবর্ষ অনুষ্ঠানে, কলকাতার স্বপন বসু, লোপামোদ্রা, অভিজিত বসু, কুন্তল রায়, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সম্পা বিশ্বাস, দোহার, মাদল,সর্বানী ভট্টাচার্য, গঙাধর তুলিকা, তীর্থ, প্রাণেশ সোম, বাংলাদেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী সেলিম চৌধুরী ও সিলেটের পল্লবী দাস সংগীত পরিবেশন করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত