শাকিলা ববি

২২ অক্টোবর, ২০২৪ ১৬:১০

মরমী গানের আড্ডায় ‘জোছনাযাপন’

আকাশে রুপালী চাঁদের আলো। হালকা কুয়াশা ও ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। চা বাগান সংলগ্ন একটি বাড়ির উঠানে বিছানো শীতলপাটিতে বসে গান ধরলেন বাউলশিল্পী মঞ্জিল আহমদ। লোকসাধক ক্বারি আমির উদ্দিনের 'জোছনা সুধা পান করিব, তারা হয়ে আমার গান। হৃদয়ে থাক আমার হৃদ আকাশের চান। বন্ধু তুমি আমার জানের জান, বন্ধু তুমি আমার প্রাণের প্রাণ' গান দিয়ে শুরু করলেন আসর। চাঁদের আলোতে গান শুনতে আশপাশের বাড়ির নিয়নবাতিগুলো বন্ধ করে দিলেন গৃহিণীরা। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের মানুষজন এসে উঠানে বিছানো শীতলপাটিতে বসে গেলেন। চাঁদের আলোর রোশনি আর বাউল মঞ্জিলের গানে মাতোয়ারা হয়ে গেল আসর।

বুধবার (১৬ আগস্ট) রাত নয়টায় আলী বাহার চা বাগান সংলগ্ন সিলেট সদর উপজেলার ৬নং টুকেরবাজার ইউপির শ্যামলনগর ভাটা গ্রামের মেম্বার বাড়িতে শুরু হয় ‘জোছনাযাপন’। সাংস্কৃতিক সংগঠন মেঠোসুরের আয়োজনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে মরমি গানের আড্ডায় জোছনা উপভোগ।

বাউলশিল্পী শীতন বাবু পরিবেশন করেন, বাউল আবদুল করিমের গান- ‘আমি গান গাইতে পারি না’, ক্বারি আমির উদ্দিনের গান, ‘কোকিলা দিস না রে জ্বালা’, মঞ্জিল আহমদ আরও শোনান ‘শ্যাম আমারে ভুইল না’, ‘মদিনা জানে ওয়ালা’। বিমান তালুকদারে অনুবাদক, কবি জাহেদ আহমদের গান ‘স্বাগত জানাই’, বাউলের বর্ম, অনঙ্ক হৃদয়, বুদ্ধায়ু, বুদ্ধবায়ু গান। রঞ্জু কর শোনান দুর্বীণ শাহ্-র গান 'তুই যদি হইতি গলার মালা চিকনকালা', গিয়াস উদ্দিনের গান 'ওরে লাগাল পাইলে কইও প্রাণ সই আমার বাড়ি আইতো', করিমের 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।' উদীচীকর্মী, সংগীতশিল্পী সন্দ্বীপ শোনান কাজলরেখা ছবির গান ‘ঘুমাইলা ঘুমাইলা সখি পান খাইলা না’, সংগীতশিল্পী রঞ্জু কর শোনান ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

পেশায় রাজমিস্ত্রি ভাটা এলাকার বাসিন্দা আশিকুর রহমান। তিনি এসেছেন গান শুনতে। পেশাদার শিল্পীদের গান শুনে আশিকুর রহমানেরও গান গাইতে ইচ্ছা হলো। আয়োজকদের তিনি আর ইচ্ছার কথা জানালে তাকেও গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। নবীজীর শানে গান ধরলেন আশিকুর রহমান। ‘আল্লার নবী, নূরে নবীগো আপনি আমার জীবনের জীবন’ গান গেয়ে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেন আশিক। তিনি বলেন, গান আমার খুব ভাল লাগে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম গান হচ্ছে তাই গান শুনতে চলে আসলাম। এখন গান গেয়েও খুব ভাল লাগছে।

একই এলাকার কিশোর সালমান আহমদ গান শুনতে আসে তার কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে। সালমান আহমেদ (১৬) বলে, এরকম গানের আসর আগে আমাদের এলাকায় হতো। এখন হয় না। তাই গানের শব্দ শুনে চলে আসছি বন্ধুদের নিয়ে।

আসরে গান শুনতে ও জোছনাযাপন করতে সিলেট শহর থেকে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক নিরুপম তালুকদার। তিনি বলেন, বিমান দার আমন্ত্রণে এই গান ও জোছনা উপভোগ করতে এসেছি। এরকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখা দরকার। আমি গান গাইতে পারতাম না। এখন বিমান দার সাথে এধরনের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে এসে তাদের সাথে সুর মিলাতে পারি।

যে মেম্বার বাড়ির উঠানে গানের আশর বসেছে সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী সুফিয়া বেগম। উঠানে পাটি বিছানো থেকে শুরু করে চা - পান সুপারি দিয়ে উপস্থিত সকলকে তিনিই আপ্যায়ন করেন। অনেক উৎসাহের সাথে তিনি এই কাজগুলো করছিলেন এবং বারান্দায় বসে বাড়ির অন্যান্য নারীদের নিয়ে গান শুনছিলেন। সুফিয়া বেগম বলেন, আগে এধরণের আয়োজন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই হতো। আমার শ্বশুর, ভাসুর এ ধরনের আয়োজন করতেন। ভাসুর মারা যাওয়ার পর গত তিন বছর ধরে আর গান হয় না বাড়িতে। তিনবছর পর আবার গান হইছে বাড়িত। তাই অনেক ভাল লাগছে। আমার বিয়ের পর যখন এই বাড়িতে আসি তখনও গান হলে আমরা উঠানে পাটি বিছিয়ে আয়োজন করি দিতাম। সবাইকে চা, পান- সুপারি খাওয়াতাম। তাই এই গানের আসরে সবাইকে আপ্যায়ন করতে পেরে ভাল লাগছে।

আয়োজন প্রসঙ্গে আয়োজক মেঠোসুর সম্পাদক ব্রতচারী বিমান তালুকদার বলেন ‘দীর্ঘদিন যাবত কোজাগরী পূর্ণিমায় ‘জোছনাযাপন’ করে আসছি। শরতের আকাশ সবচেয়ে স্বচ্ছ থাকে। রাতে চাঁদের আলো বেশি বিকিরণ করে। ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে চিড়া-মুড়ির নাড়ুসমেত হালকা চা-নাস্তায় কোজাগরী পূর্ণিমা নানা সময়ে নানা জায়গায় কখনো হাওরে, কখনো পাহাড়ে, কখনো মুরারিচাঁদ কলেজের পুকুর পাড়ে আয়োজন করা হয়। একটু প্রকৃতিনির্ভর, প্রকৃতির কাছাকাছি নিস্বর্গনশ্বর সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা। আগামী দিনেও হবে আশা করি।

তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি লক্ষ্মীপূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে একদল ছোটোখাটো ভেষজ ফুল-ফল-শস্যাদি চুরি আর আরেকদল চুরি রোধ করার চেষ্টা করতো। কোনো না কোনোভাবে মনে হয় উভয়েরই উপচে পড়া ভেষজ চাঁদের আলো গায়ে-মনে মাখা, সজাগ থাকার চেষ্টা। এই জোছনাযাপনকে উপলক্ষ করে আড্ডা-গান-কথা-কবিতা-দ্রোহে সৃজনানন্দের চর্চা ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আয়োজনে বক্তব্য দেন কবি, অনুবাদক জাহেদ আহমদ, অ্যাডভোকেট, সংগঠক অরূপ শ্যাম বাপ্পী, সাংবাদিক, লেখক শামস শামীম, ড. ফয়েজ আহমদ রাজীব।

বক্তারা বলেন, ‘এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে এসেছে। বড় পরিসরে আমরা যা দেখি তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রদর্শনী। আজকের আয়োজন মৃত্তিকাশ্রয়ী, প্রকৃতিনির্ভর ব্যতিক্রমী আয়োজন। ছোটছোট কাজ, আয়োজন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই আড্ডা আয়োজন চলুক।’

জোছনাযাপনে অংশগ্রহণ করেন ভাটা নিবাসী সিরাজ মিয়া, ব্যাংকার নিরূপম তপু, সাজন মিয়া, সাংবাদিক শাকিলা ববি, ক্রীড়া সংগঠক, শিক্ষক বিজন বিহারী তালুকদার, ফটো সাংবাদিক মামুন হোসাইন, উদ্যোক্তা সুমন সূত্রধর, দিগন্ত সিমসাং নিক, নাট্যকর্মী সুজন আচার্য্য শ্রাবণ, চিত্রশিল্পী দ্বীপ দাস, সংস্কৃতিকর্মী রকি দাস, সমাজকর্মী ফয়জুল হক, নাট্যকর্মী আব্দুল মালিক, শিশুশিল্পী মেহেকসহ স্থানীয় মানুষজন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত