
১১ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:২৬
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক শিক্ষার্থী মারজানা আক্তার বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জাতিসংঘের ইয়াং উইমেন ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপ–২০২৫ প্রোগ্রামে।
বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্য থেকে মাত্র ১০ জন তরুণী গবেষক এই মর্যাদাপূর্ণ ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী।
জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক দফতর (ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর ডিসআর্মমেন্ট অ্যাফেয়ার্স) জীববিজ্ঞানের নিরাপদ ব্যবহার ও বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই ফেলোশিপের আয়োজন করেছে। বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই প্রোগ্রামের সমাপনী অনুষ্ঠান আগামী ডিসেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন মারজানা আক্তার।
মারজানা সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তার আগে তিনি শাবিপ্রবির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
তার স্নাতকোত্তর গবেষণায় তিনি দেশের পোলট্রিতে চিকেন ইনফেকশাস অ্যানিমিয়া ভাইরাস নিয়ে কাজ করে প্রথমবারের মতো Genotype IIIb স্ট্রেইন শনাক্ত করেন, যা বাংলাদেশের ভাইরোলজি গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত। এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন।
মারজনার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক অনন্য সংগ্রামের গল্প। স্নাতকোত্তর পড়ার সময় তিনি ছিলেন গর্ভবতী। ক্লাস, ল্যাব, থিসিস—সবকিছুই তিনি চালিয়ে গেছেন শারীরিক কষ্টের মধ্যেই। গর্ভাবস্থার ছয় মাসে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয় তাকে। ঠিক সে সময় তার স্বামী ইউশা আরাফ নিউজিল্যান্ডে অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে চলে যান। একা ও অসুস্থ অবস্থায় থেকেও থেমে থাকেননি মারজানা।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাপান সরকারের সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। কয়েক মাস পর কন্যা আনাইজার জন্মের পর, শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই তিনি থিসিস ডিফেন্ড করেন এবং সফলভাবে গবেষণা শেষ করেন।
নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে মারজানা বলেন, “আমার যাত্রাটা ছিল কঠিন, কিন্তু আমি জানতাম হাল না ছাড়লে একদিন এ কষ্টই আমার শক্তি হবে। আনাইজা আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।”
তিনি আরও বলেন, “জাতিসংঘের ফেলোশিপ পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন। আমি চাই, দেশের মেয়েরা জানুক—কোনো কষ্ট বা বাধাই স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না। বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করাই এখন আমার লক্ষ্য।”
তার স্বামী ইউশা আরাফ বলেন, “মারজানার এই অর্জন শুধু আমাদের পরিবারের নয়, এটি বাংলাদেশের গর্ব। সে প্রমাণ করেছে, সাহস ও পরিশ্রম থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।”
মাত্র অল্প বয়সেই মারজানার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে নয়টি আন্তর্জাতিক জার্নালে। তার গবেষণার ক্ষেত্র ভাইরোলজি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) এবং সংক্রামক রোগবিষয়ক।
জাতিসংঘের ফেলোশিপের মাধ্যমে মারজানা এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে জীববিজ্ঞান ও বায়োসিকিউরিটি বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। শাবিপ্রবির এই সাবেক শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণাদায়ক যাত্রা প্রমাণ করে, প্রতিকূলতা জয় করেই তৈরি হয় সত্যিকারের বিজ্ঞানী।
এর আগে, মারজানার স্বামী ইউশা আরাফ ২০২৩ সালে ইয়ুথ ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবারে মারজানা দেশের প্রথম নারী প্রতিনিধি হিসেবে ইতিহাস গড়লেন।
আপনার মন্তব্য