দেবব্রত চৌধুরী লিটন

১৫ জুন, ২০২০ ২১:৩৫

নির্ভরতার কামরান


সিলেট নগরীর মানুষের নির্ভরতার জায়গায় স্থান করে নিয়েছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। দল কিংবা দলের বাইরের যে কেউরই ছিল তার বাসায় অবাধ যাতায়াত। বাসায় ঢুকে কারো কাছ থেকে উনি বেড রুমে আছেন জানলে কোন অনুমতি ছাড়াই বিনা বাঁধায় দু'তলার সিঁড়ি মারিয়ে অনায়াসে যে কেউ যেতে পারতেন তার বেড রুম পর্যন্ত।প্রয়োজনের কথাগুলো তিনি ধৈর্য ও গভীর মনোযোগে শুনে আশ্বস্ত করতেন। কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছানো সেই মানুষটিকে চেনা জানার চেষ্টা করতেন কামরান। কারো চরম সংকটের কথা শুনে ঘটনার ভাবাবেগে আপ্লুত হতেন তিনি নিজেই।

আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সরব থাকতেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। দলীয় কোন কর্মী রাজপথের আন্দোলনের সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে বুক চিতিয়ে এগিয়ে যেতেন এই জননেতা। কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কখনওবা শুয়ে পড়তেন রাজপথে। তার উপর পুলিশের হামলাগুলো গুনে শেষ করা যাবেনা। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আক্রোশের কারণে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন অসংখ্য বার।

২০০৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন কামরান। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুই বার কারাবরণ করতে হয় সিলেটবাসীর প্রিয় এই মানুষটিকে। ২০০৮ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

জেল থেকে মুক্তির পর আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কামরানের দেয়া তখনকার বক্তব্য গণমানুষের কানে এখন সুর হয়ে বাজে।

বিজ্ঞাপন

বক্তব্য দিতে গিয়ে বলতেন - "আমি তখন কুমিল্লা কারাগারে। আমাকে বলা হল উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হবে। আমি কারাফটকের সামনে থেকে গাড়িতে উঠলাম। দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে চলার পর গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম আমি পৌঁছেছে সিলেটে। তখন আমাকে বলা হল আমার মা আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। মায়ের মৃত্যুতে আমাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হল। আমার জনমদুখী মা আমি জেলে থাকা অবস্থায় আপনাদের কাছে ভোট ভিক্ষা চেয়েছিলেন। আমার মায়ের কথায় আপনারা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন। আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী। "

মঞ্চে কথা বলতে গিয়ে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সুরেলা কণ্ঠে একাধিক গান ধরতেন প্রায়শই। সিলেটের বিভিন্ন মঞ্চে প্রায় তাঁর কণ্ঠে গীত হতো - "কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়", "সালাম সালাম হাজার সালাম", " বন্ধু হতে চেয়ে শত্রু বলে গণ্য হলাম"।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সোমবার ভোরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিলেটবাসীর প্রিয় নাম বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।

উত্তাল সময়ে ১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে কামরানের হাতেখড়ি। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় ৭৩ সালে সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার হয়ে চমক দেখান এই জননেতা। সেই থেকেই সিলেট পৌরসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন তিনি। টানা ১৫ বছর ছিলেন পৌরসভার কমিশনার। মাঝখানে প্রবাসে থাকায় একবার নির্বাচন থেকে বিরত ছিলেন। ফিরে এসে ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন হলে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান কামরান। ২০০৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। ২০০৮ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন।

শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সিলেটের আওয়ামী রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বে আসেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১৯৮৯ সালে। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে প্রথমবারের মত সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন কামরান। ২০০৫ এ সম্মেলনের মাধ্যমে এবং ২০১১ সালে গঠিত কমিটিতে মহানগর আওয়ামী লীগের পুনরায় সভাপতির দায়িত্ব পান। দীর্ঘ তিন দশক সিলেটের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।

আজ সিলেটবাসী হারিয়ে ফেললাম নিজেদের প্রিয় এই মানুষটিকে। বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন সিলেটের সত্যিকার অর্থেই একজন অভিভাবক। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বেড়ে উঠে কামরান প্রকৃত অর্থেই হয়েছিলেন জননেতা। দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে সিলেটের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কখনো ধুসর হতে দেননি। কোন আক্রোশ না দেখিয়ে পক্ষ ও বিপক্ষের সবাইকে ছায়া দিয়েছেন এই নেতা। সিলেটের মানুষের নির্ভরতার একমাত্র প্রতীক ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।

দেবব্রত চৌধুরী লিটন : আইনজীবী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত